ভোটহীন শাসনের বিরুদ্ধে জনতার রায়

সানাউল্লাহ সাগর
১৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ভোটহীন শাসনের বিরুদ্ধে জনতার রায়

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত অথচ গৌরবময় ঐতিহাসিক দিন। এই দিনেই ভেঙে পড়ে ভয়, প্রতারণা ও নিপীড়নের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। এ ছিল এক ভয়ভীতি ও প্রতারণানির্ভর স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার অবসান, যাকে জনতার রায় ভেঙে চুরমার করে দেয়। জনতার অভূতপূর্ব প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগ সেই ক্ষমতাকে শুধু টলিয়ে দেয়নি, ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলেছে। আজ তার এক বছর পর দাঁড়িয়ে, আমরা শুধু একটি শাসকের পতন নয়, স্মরণ করি একটি বিকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতির, একটি প্রহসনময় নির্বাচনী ব্যবস্থার এবং রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে জনগণের সাহসী প্রত্যাখ্যানকে।

এই রায় আদালতে দেওয়া হয়নি। এই রায় ঘোষিত হয়নি ব্যালট বাক্সে। বরং এটি এসেছে রক্তে, রাজপথে, গুমের শোকে, বাঁচার লড়াইয়ে, তরুণদের অগ্নিদীপ্ত চোখে। জনতার এই রায় ছিল একদম স্পষ্ট- ভোট ছাড়া রাষ্ট্র চলতে পারে না। রাষ্ট্র মানে সরকার নয়, রাষ্ট্র মানে জনগণ।

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার শাসনকালের শেষ দশক ছিল রাজনৈতিক বিভ্রম, উন্নয়নের ফাঁপা বুলি, আর নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের কালো অধ্যায়। একদিকে মেগাপ্রকল্প, অন্যদিকে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ। একদিকে র?্যাব-পুলিশের ভয়াবহ দমননীতি, অন্যদিকে উন্নয়নের পোস্টার। এই শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন ছিল একটি নাটক মাত্র; যেখানে দর্শক ছাড়া দর্শকসারি সাজানো থাকত, আর অভিনয় করতেন একপক্ষীয় প্রার্থীরা।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়; যেখানে ভোটারহীন নির্বাচন, আগের রাতেই ব্যালট পূরণ এবং বিরোধী দলবিহীন পার্লামেন্ট গঠনের মতো ঘটনা জনগণের মাঝে ভয়, হতাশা ও একপ্রকার রাজনৈতিক নির্লিপ্ততা তৈরি করে। নির্বাচনের নামে এই প্রহসন মানুষকে আশাহত করে দেয় গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা থেকে। কিন্তু মানুষ ভুলে যায়নি ভোট দিতে চাওয়ার ইচ্ছা, ভুলে যায়নি রাষ্ট্রের প্রতি তাদের অধিকারপ্রাপ্তির দাবি। ২০২৪ সালে এসে সেই অবদমিত আকাক্সক্ষা যখন আরেকবার পদদলিত হলো, যখন ভোটের নামে আবারও চালানো হলো একতরফা অধিকারহরণ, তখনই জনগণের সহ্যের বাঁধ ভেঙে পড়ে।

এবার কোনো রাজনৈতিক দলকে সরাসরি ডাক বা নেতৃত্বে দেখা যায়নি; বরং দেখা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে। এরপর সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে গুম হওয়া মানুষের স্বজন, দিনমজুর, বঞ্চিত মধ্যবিত্ত, নিম্ন আয়ের মানুষ। পাড়া-গলি পেরিয়ে মফস্বলের শিক্ষিত তরুণ-তরুণী পর্যন্ত। এরা রাজপথে নেমেছে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায়। তাদের দাবিগুলো খুব সাধারণ, অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভোটের অধিকার চেয়েছে, নিজের পছন্দের প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করতে চেয়েছে। তারা চেয়েছে মুক্তভাবে কথা বলার অধিকার। তারা চেয়েছে নির্ভয়ে মত প্রকাশের সুযোগ, নাগরিক মর্যাদা। কিন্তু যখন রাষ্ট্র নিজেই জনগণের অধিকারের প্রশ্নে সহিংস হয়ে ওঠে, তখন জনগণ আর চুপ থাকে না।

৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ছিল জনগণের একটি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, অপমান, হাহাকার, আর প্রতারণার বিরুদ্ধে এক দুর্র্ধর্ষ জবাব। যদিও এক দিনে এই আন্দোলন তৈরি হয়নি। এই জনরোষের বিস্ফোরণ পনেরো বছর ধরে একটু একটু করে তৈরি হয়েছে।

শহরের রাস্তায়, গ্রামের স্কুল মাঠে, জেলা শহরের প্রশাসনিক ভবনের সামনে, বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে সেদিন পতাকা ও প্ল্যাকার্ড হাতে লাখ লাখ লোক জড়ো হয়েছিল। ঘরের মা সন্তান হারিয়েছিলেন, সাংবাদিক হারিয়েছিলেন সহযোদ্ধা, ছাত্ররা হারিয়েছিল সহপাঠী। আর ক্রিয়াশীল বিরোধী রাজনৈতিক দলের ত্যাগ ছিল সবার চেয়ে বেশি। আর এত ত্যাগের পর তারা ফিরে পেয়েছিল নিজেদের মর্যাদা, কথা বলার অধিকার। তারা রাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছিল, শুধু লোকদেখানো উন্নয়ন নয়, মানুষ চায় নাগরিক অধিকার। আর ভোট হলো সেই অধিকারের মূলস্তম্ভ। শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের এই পতন নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী ঘটনা, যা দীর্ঘ আন্দোলনের পর অর্জিত হয়েছে। তবে প্রশ্ন জাগে, একি কেবল ক্ষমতার বদল, নাকি শাসনব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন? একনায়কত্বের পতনের এক বছর পর দাঁড়িয়ে, আমরা দেখছি- আংশিক স্বাধীনতা, অনিশ্চিত গতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। এখনও যেন পরিষ্কার কিছু বোঝা যাচ্ছে না। বরং সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে দেশে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। এবং এই সুযোগে অনেক জায়গায় পুরনো শাসনের অনুগতরাই আবার মাথা তুলছে নতুন মুখোশে। এ যেন পচা গাছ কাটার পরে তার গোড়া রেখে দেওয়া, যেখানে আবার শাসনের অশুভ শিকড় গজিয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে জনতার রায় শুধু একটি দিন নয়, সেটি ধারাবাহিকভাবে সচেতনতা, প্রতিরোধ, আর রাজনৈতিক বিবর্তনের চর্চা হয়ে উঠতে হবে। এই বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি ছিল তরুণসমাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কলেজের শিক্ষক, প্রযুক্তিবিদ, এমনকি অরাজনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তারা নিজস্ব সচেতনতার ভিত্তিতে রাজপথে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই তরুণদের জন্য এখন বড় প্রশ্ন : তারা কি কেবল একটি স্বৈরাচারকে সরিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ মনে করবে? নাকি তারা ভবিষ্যতের রাষ্ট্র গঠনে অংশ নেবে- নৈতিকতা, গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিতে?

জনগণের রায় যদি কেবল একটি মুখ পরিবর্তনের মধ্যে সীমিত থাকে, তবে তা একসময় গণবিচ্ছিন্নতা, হতাশা ও নতুন একনায়ক তৈরির বীজ বপন করবে। তরুণদের জাগরণ যেন আবার নিস্তেজ না হয়ে পড়ে, সে জন্য নাগরিক উদ্যোগ, সাংস্কৃতিক জাগরণ ও রাজনৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

এই রায়ের মূল্য যে মানুষগুলো দিয়েছে, তারা অধিকাংশই আজ মৃত, নিখোঁজ বা পঙ্গু। কেউ মুখে বুলি কপচায় তাদের স্মরণে, কেউ তাদের ছবি ব্যানারে ব্যবহার করে, কেউ তাদের নামেই রাজনৈতিক ফায়দা তোলে। কিন্তু শহীদ পরিবার, নিখোঁজদের মা, অন্ধ হয়ে যাওয়া জুলাই যোদ্ধা- তারা এখনও রাষ্ট্রের যথাযথ পুনর্বাসন থেকে বঞ্চিত। তাদের নিয়ে একটি জাতীয় স্মারক কমিশন, একটি স্বীকৃতিকাঠামো, একটি ন্যায়বিচারভিত্তিক পুনর্বাসন উদ্যোগ গড়ে তুলতে হবে। না হলে এই বিপ্লবও হয়ে যাবে ’৯০ সালের মতো গণ-আন্দোলন।

স্বৈরশাসন অবসানের দিন ৫ আগস্ট ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষের একটি ঐতিহাসিক রায়। জনগণের এই রায় শুধু ভোটহীন শাসনের বিরুদ্ধে নয়, পুরো রাষ্ট্রের বিকৃত ধারার বিরুদ্ধে। এই রায়ের বৈধতা কোনো আদালত দেননি, দিয়েছে মানুষের আত্মদানের সম্মতি। এক বছর পরে এসে সেই রায়কে সম্মান জানাতে হলে, শুধু স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের ইতিহাস স্মরণ নয়, ভবিষ্যতের দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা, নতুন নেতৃত্ব, নতুন মূল্যবোধ- এই তিনটি জিনিস তৈরি না হলে, ৫ আগস্ট কেবল একটি দিবস হবে। দিবস থেকে ইতিহাস হবে না।

সানাউল্লাহ সাগর : কবি ও কথাসাহিত্যিক