ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কে বাংলাদেশের কী লাভ

আদনান আরিফ সালিম
১০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কে বাংলাদেশের কী লাভ

যুক্তরাষ্ট্র একাধারে চীনা ও ভারতীয় পণ্যের ওপর নতুন করে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। এতে দেশগুলোর বাণিজ্য খাতের অংশীজনরা স্ব স্ব অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টা তাদের জন্য কতটা নেতিবাচক সেটা বোঝার জন্য বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে নতুন এই শুল্কনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগসূত্র অপেক্ষাকৃত ভিন্ন এবং কিছুটা ইতিবাচক বটে।

অনেকে দাবি করছেন, ভারত ও চীনের তুলনায় কম শুল্ক-করের মারপ্যাঁচে থাকায় বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এই নীতি থেকে। বিশেষত, তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে নতুন করে রপ্তানি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির এক বড় সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। পাশাপাশি এই সুযোগকে কাজে লাগাতে দেশের পোশাকশিল্পসংশ্লিষ্টদের আরও বেশি সতর্ক ও আন্তরিক হতে হবে।

কম খরচে অধিকসংখ্যক শ্রমিক নিয়োগের যে সনাতনী নীতি, সেখানে প্রচুর গলদ। কর্মীদের নামমাত্র বেতন-ভাতায় পশুর মতো শ্রম দেওয়ানোর একটা নষ্ট সিস্টেম এখানে গড়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে বিশ্বের নানা দেশের মানবাধিকার সংস্থা প্রতিবাদ করে আসছে। এর পরও দৃশ্যমান কোনো মানবিক ও কর্মীবান্ধব উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বললেই চলে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এর পরও টিকে আছে কেন? লজ্জার বিষয় হলেও সত্য যে, পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি দেশের অবকাঠামো যাচ্ছেতাই ভঙ্গুর। সেখানে প্রতিযোগিতা চলে মানবিক বোধ ও শ্রমিক অধিকারহরণের ক্ষেত্রে কে কার থেকে কতটা নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট হতে পারে। সে হিসাবে তুলনামূলক কম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে একই সমান্তরালে নামমাত্র মূল্যে শ্রমিক পেয়ে যাওয়ার ইঁদুর দৌড়ে যারা এগিয়ে থাকে তাদের পোয়াবারো। সে জন্যই ব্রিটিশ আমলে নীলকরদের নির্যাতনের গল্পগুলো দীনবন্ধু মিত্রের লেখা থেকে জেনে আজও কেউ কেউ চোখের পানি ফেলে। কিন্তু তার বিপরীতে হা-হা হি-হি করে পোশাকশিল্পের গুণগান করে।

ইতোমধ্যে মার্কিন প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের ওপর যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে তা আরও বাড়বে। তারা জানিয়েছে ভারত রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি অব্যাহত রাখলে তার পরিণতিতে এই শুল্ক বৃদ্ধি পাবে। ধারণা করা যায়, আগামী ২৭ আগস্ট থেকে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক ভারতের ওপর কার্যকর হবে। প্রাথমিকভাবে বলা যায়, এতে ভারতের প্রায় ৮৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি প্রত্যক্ষভাবে হুমকির মুখে পড়বে।

শুল্ক বৃদ্ধি ভারতের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিতে যত বড় ধাক্কা দিতে যাচ্ছে তা তাদের জন্য কল্পনাতীত। আর এখানেই আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের জন্য প্রতিযোগিতামূলক কিছু সুবিধা তৈরি করছে। অন্যদিকে, চীনের ওপর বর্তমানে ৩০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপিত। এই শুল্কহারও ভবিষ্যতে বাড়তে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো এখন তুলনামূলকভাবে কম শুল্কহারপ্রাপ্ত দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটাই সুবিধাজনক। কারণ, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম- এই দুটি দেশেই বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক প্রযোজ্য। রপ্তানিকারকরা বলছেন, চীন ও ভারতের তুলনায় এখান থেকে পণ্য আমদানি করলে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ সাশ্রয় করতে পারেন।

খরচ হ্রাসের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার মধ্য দিয়েই মূলত মার্কিন ক্রেতারা তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তা করছে। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের এই বাংলাদেশমুখী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারাটা সহজ নয়। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ বলছেন, এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে এটা অনেক বড় বাধা হয়ে আছে। কারণ, গ্যাসসংকটে দেশের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ টেক্সটাইল শিল্প কাক্সিক্ষত উৎপাদনক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে না।

বাংলাদেশে পোর্ট পরিচালনার দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গতিমন্থরতা দূর করতে হবে। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে অর্থায়ন সহজীকরণ ও বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালার প্রয়োগ করতে হবে। আর এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কোনোটিকে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই, বরং প্রতিটিই অপরিহার্য বলে মনে করেন রপ্তানিকারকরা।

এর পরও ধরে নেওয়া যায়, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক ভারসাম্যের পরিবর্তনের এ সময়টিতে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলে বাংলাদেশ নতুন এক রপ্তানির্ভর বাণিজ্যে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিশীল গন্তব্যে পরিণত হতে পারে। বিশ্বের অন্যতম ক্রেতাদের বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হলে সেটা হবে দুর্দান্ত একটা সুযোগ। তবে বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্যকাঠামোর দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে হবে বাংলাদেশকে।

পোশাকশিল্পের জন্য রপ্তানি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির যে ব্যতিক্রমী সম্ভাবনার সূচনা হয়েছে তাকে কাজে লাগতে হবে। কারণ, আগে যেখানে চীন ও ভারতের মতো বিশাল বাজার অংশীদারদের সামনে বাংলাদেশ দাঁড়াতেই পারত না, নতুন শুল্ক আরোপে তাদের এখন বিপর্যস্ত অবস্থা। স্বাভাবিকভাবেই যখন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা নতুন বিকল্প খুঁজছেন এবং ভবিষ্যতেও খুঁজবেন, তখন বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মতো উৎপাদনসক্ষম ও তুলনামূলকভাবে কম শুল্কহারপ্রাপ্ত দেশগুলোর জন্য সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে।

তবে পণ্যের গুণমান ও সময়মতো সরবরাহের সক্ষমতা না থাকলে বড় ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে একটুও দ্বিধা করবেন না। এ জন্যই রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ ও অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধানের বাইরে অন্য কোনো পাথ খোলা নেই। তৈরি পোশাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তা যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে নতুন সরবরাহকারীর সন্ধান করবে। সেখানে চীন ও ভারত তাদের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্ক নিয়ে ধুঁকছে। এই সময় ক্রেতারা কম শুল্ক ও খরচ সাশ্রয়ের দিকে মনোযোগ দিলে সেখানে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে বহুগুণে। ধরেই নেওয়া যায়, তাদের বিনিয়োগ কেবল তৈরি পোশাক খাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা সুতা, কাপড়, ডায়িং, অ্যাক্সেসরিজ, লজিস্টিকস সবখানেই হাত দেবে। আর তাতে নতুন কর্মসংস্থান ও সক্ষমতা তৈরির পথ খুলতে পারে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ কতটা কার্যকর করতে পারবে বাংলাদেশ? বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি যে ভৌগোলিক বিভাজন তৈরি করছে তার বেলায় কী হবে? যুক্তরাষ্ট্রের কর আরোপের বিপরীতে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো যদি বিকল্প কোনো বাণিজ্যপথ অনুসন্ধান করে সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আর এসব প্রশ্নকেও একপাশে রাখলে একটি কাজ আমাদের করতেই হবে- তা হচ্ছে, অবকাঠামোগত এবং গুণগত মনের উন্নয়ন। পাশাপাশি সক্ষমতা এবং মানবিক বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দিতে হবে। রপ্তানি বাজার হিসেবে সাফল্যকে টেকসই করতে পারলে আমরা সহজেই ট্রাম্পের আরোপিত উচ্চ শুল্ককে শাপে বর হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। কারণ, ভারত কিংবা চীনের বিপন্ন দশার বিপরীতে বাংলাদেশের অনেক লাভের খায়-খতিয়ান এখানে জড়িয়ে রয়েছে নিশ্চিত করেই।


ড. মো. আদনান আরিফ সালিম : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়