সশস্ত্র বাহিনী ও জাতীয়তাবাদের পুনর্জাগরণ
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী কেবল একটি বাহিনী নয় বরং এটি একটি জাতির আত্মার স্পন্দন এবং একটি আদর্শ রূপায়ণের, বাস্তবায়নের অন্যতম পথিকৃৎ। সেই আদর্শ হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এমন একটি দর্শন, যা কিনা জনগণের সার্বভৌমত্ব, ধর্মীয় সহনশীলতা, গণতান্ত্রিক চেতনা এবং আত্মমর্যাদার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেকটি সদস্য, হোক সে একজন সিপাহি বা একজন জেনারেল- এই আদর্শে বিশ্বাসী বলেই তারা দেশের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকে। এই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে আমাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, জাতীয় সংগ্রাম এবং একজন মহান নেতার দূরদর্শী নেতৃত্ব থেকে, যিনি হলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
বাংলাদেশের জন্ম কোনো সহজ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়নি। দীর্ঘকাল ধরে পাকিস্তানি শাসন এবং বাঙালি জাতির ওপর বঞ্চনার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭১ সালে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। এই মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা ছিল অনন্য। একাত্তরের সাহসী সৈনিকরা রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন করেছিল, আর সেই আত্মত্যাগ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয় চেতনার এক অবিনাশী ধারাবাহিকতা। এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে নানা সংকট, ষড়যন্ত্র ও কূটচাল পেরিয়ে আজও বাংলাদেশের অস্তিত্বের ভিত্তি হিসেবে টিকে আছে। এই চেতনার নামই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে একটি বিশেষ মহল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং এর পরবর্তী ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড, ক্যু-কাউন্টার ক্যু-এর মধ্য দিয়ে জাতি চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তখন চরম হতাশা, অনিশ্চয়তা এবং বিভ্রান্তি দেখা দেয়। ঠিক সেই সময়ে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে এক ঐতিহাসিক সিপাহি-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়। জনগণের আস্থা, সেনাবাহিনীর সমর্থন এবং একটি আদর্শিক ভিত্তি নিয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম সেনাবাহিনীকে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেননি।
শহীদ জিয়া তার ভাষণে বারবার উল্লেখ করেছেন- ‘আমরা একটি আদর্শভিত্তিক জাতি গঠন করব, যেখানে সশস্ত্র বাহিনী হবে জনগণের বাহিনী।’ এই চিন্তা থেকেই সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, ব্যক্তি-বন্দনার সংস্কৃতি এবং মতাদর্শিক বিভাজন থেকে মুক্ত করে একটি জাতীয় চেতনানির্ভর কাঠামোয় পুনর্গঠিত করা হয়। শহীদ জিয়ার কৌশল ছিল সোজাসাপ্টা- ‘জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, পেশাগত দক্ষতা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিষ্ঠা।’ এই লক্ষ্যেই তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি স্তরে পুনর্গঠন, পেশাগত মানোন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও আদর্শিক শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রোথিত করেন। তার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি দেশের ভেতরেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়, জঙ্গি দমন ও অবকাঠামো উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ফ্যাসিবাদী অপশক্তি এই বাহিনীকে নিজেদের ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে যখন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার নামে কিছু গোষ্ঠী রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যকে ব্যবহারের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমূর্তিকে কলুষিত করেছে, তখন জাতি দুর্মহ এক অন্ধকারে পতিত হয়েছে। এই অপচেষ্টা কখনোই মূল সেনাকাঠামোর নীতির প্রতিফলন নয়। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সশস্ত্র বাহিনীর ঐতিহ্য, আত্মত্যাগ এবং আদর্শিক ভিত্তিকে অসম্মান করে।
এর পরও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী তার মূল বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে সরে যায়নি। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আহ্বানে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন শুরু হলে জনগণের বিপুল সমর্থনে একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই গণ-আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিবাদী অপশক্তির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক ছিল না বরং এটি ছিল একটি আদর্শিক জাগরণ- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান। এই পুনরুত্থানে সশস্ত্র বাহিনী পুনরায় তাদের প্রকৃত পরিচয়ে ফিরে আসে- একটি জাতীয় বাহিনী, যারা জনগণের পক্ষেই দাঁড়িয়েছে, কোনো ফ্যাসিবাদী দমন-নিপীড়নের পক্ষে নয়। এই ঘটনায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী আজ কেবল একটি বাহিনী নয়- এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ধারক। এই বাহিনী শুধু অস্ত্রচালনায় নয়, বরং নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, মানবিকতা এবং পেশাদারত্ব- এই চার মূলস্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই নৈতিক অবস্থান তাদের করে তুলেছে জাতির গর্ব, জাতির ভরসা। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের সাফল্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তাদের সাহসিকতা, অবকাঠামো নির্মাণে তাদের দক্ষতা এবং রাজনৈতিক সংকটে তাদের পেশাগত নিরপেক্ষতা- সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আজ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সুসংগঠিত এবং আদর্শিকভাবে শক্তিশালী বাহিনী।
তবে এই অর্জন কেবল বাহিনীর নিজের নয়; এটি জাতির, এটি সেই চেতনাগুলো- যা মুক্তিযুদ্ধে জন্ম নিয়েছিল এবং পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শে ও সক্রিয়তায় দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছিল। আজ যখন নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি ও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করে, তখন তাদের বুঝতে হবে- সশস্ত্র বাহিনীর শৌর্য-বীর্য কেবল বাহ্যিক শক্তিতে নয়, আদর্শিক ভিত্তির মধ্যেই নিহিত।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করেছে, যখনই জাতি সংকটে পড়েছে সশস্ত্র বাহিনীই তার নির্ভরযোগ্য আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সেই নির্ভরতার পেছনে রয়েছে একটি আদর্শিক কাঠামো, একটি বিশ্বাস, যার নাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই চেতনাই সশস্ত্র বাহিনীকে করেছে জনগণের বাহিনী, শাসকের নয়। এই চেতনাই ৭ নভেম্বরকে দিয়েছে ইতিহাসে স্থায়ী স্থান এবং চব্বিশের জুলাইকে করেছে এক নতুন জাগরণের সূচক।
সামনের দিনগুলোতে দেশকে আরও চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক মহামারী, সাইবার যুদ্ধ, জঙ্গিবাদ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা- সবই আমাদের জন্য হুমকি হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি জাতির প্রত্যাশা আরও বেড়ে যাবে। তবে সেই প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হবে তখনই, যখন বাহিনী থাকবে নৈতিকভাবে দৃঢ়, পেশাগতভাবে প্রশিক্ষিত এবং আদর্শিকভাবে জাতীয়তাবাদী।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে, তবে তার মূল আদর্শ বদলায়নি এবং সেটি হলো- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। শহীদ জিয়াউর রহমান এই বাহিনীকে যেভাবে রচনা করেছিলেন, তারেক রহমান সেই ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ভবিষ্যতেও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বাংলাদেশ কেবল ভূখণ্ড নয়, একটি আদর্শিক জাতিসত্তা হিসেবেই টিকে থাকবে। সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের হৃদয়ে এই চেতনা জাগ্রত থাকুক- এই হোক আমাদের কামনা।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ড. একেএম শামছুল ইসলাম : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক