আমলাতন্ত্রকে এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে হবে -রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর
সাক্ষাৎকার
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও প্রাসঙ্গিক সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন আমাদের সময়ের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- এমিলিয়া খানম
আমাদের সময় : জুলাই ২০২৪-এর ঘটনার পর এক বছরে দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আপনি লক্ষ করেছেন?
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর : বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের পেছনে ফিরে দেখতে হবে। বিশেষ করে জুলাই মাসের অভ্যুত্থান ও দীর্ঘদিনের গণ-আন্দোলনের পটভূমির দিকে।
২০০৮ সাল থেকে যে রাজনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে ওঠে, তা জনগণ থেকে বিযুক্ত ছিল। জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে একটি এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শাসনব্যবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে দেশ পরিচালনা করেছে এবং এক পর্যায়ে তা জনগণের চাপের মুখে অপসারিত হয়; কিন্তু তারা যাওয়ার আগে দেশের অর্থনীতিকে এমন এক খাদের কিনারায় নিয়ে যায়, যার প্রভাব আজ দেশের জনগণ প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করছে।
এ সময় তারা ‘উন্নয়নের বিস্ময়’, ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ ইত্যাদি নানা বয়ান তৈরি করে জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এমনকি গ্লোবাল মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক মহলে এই বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়; কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন- অর্থনীতি অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। ব্যাংক খাত থেকে শুরু করে সর্বত্র ছিল লুটপাট, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অব্যবস্থা।
যখন এই শাসনব্যবস্থা বিদায় নেয়, তখন খোলসের মতো খুলে যেতে থাকে পেন্ডোরার বাক্স। দেখা যায়, দেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরেই মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পিষ্ট। একদিকে পণ্যের দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে, অন্যদিকে প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মানুষ যা আয় করছে, তা দিয়ে ন্যূনতম খাদ্যও কিনতে পারছে না। চালের দাম এখনও নাগালের বাইরে।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তারা এমন এক অর্থনীতি পেয়েছে- যা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, ভঙ্গুর এবং গভীর সংকটাপন্ন। তাদের কাজ হচ্ছে- এই ধ্বংসের গতি থামানো বা ড্যামেজটা কন্ট্রোল করা। এক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু ইঙ্গিতও লক্ষ করা যাচ্ছে - সামান্য হলেও মূল্যস্ফীতি কমেছে, ব্যাংক খাতের লুটপাটে কিছুটা লাগাম টানা গেছে, বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এখনকার লক্ষ্য হতে হবে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া। তা নিতে গেলে আমাদের যুবসমাজের কর্মসংস্থান দরকার। আর কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ; বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীলতা।
আমাদের সময় : তাহলে আপনার মতে, মূল কি পরিবর্তন প্রয়োজন এখন?
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর : প্রথমত- ভ্যার্টিক্যাল ডেমোক্রেসি অর্থাৎ নিচ থেকে ওপরে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে যা আছে তা কেন্দ্রীয় সরকারের স্থানীয় রূপ, কোনো স্বশাসিত স্থানীয় সরকার নয়। দ্বিতীয়ত- সংসদ, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য (চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স) থাকতে হবে। এই ভারসাম্য ভেঙে পড়ার কারণেই একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয়েছে। তৃতীয়ত- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদব্যবস্থা ধীরে ধীরে চালু করা উচিত। পাশাপাশি রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ যেন প্রতীকী না হয়ে বাস্তব হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত- রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত বাস্তবায়নযোগ্য নির্বাচনী ইশতেহার দেওয়া- যা শুধু প্রতিশ্রুতিতে ভরা থাকবে না, থাকবে তার বাস্তবায়নের রূপরেখা।
আমাদের সময় : অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়ে কী বলবেন?
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর : অন্তর্বর্তী সরকার তো প্রকৃতপক্ষে সংস্কারের সরকার নয়। তাদের প্রধান কাজ হলো- ভয়াবহ পতনের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করা। অর্থনীতিকে সংস্কার বা পুনর্গঠনের জন্য মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।
আমাদের সময় : ঋণের জাল এবং বিনিয়োগ সংকট প্রসঙ্গে বলেছিলেন...
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর : হ্যাঁ, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণ তো আছেই। এ বছরের শুরুতেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ২১ শতাংশ বেড়েছে। অথচ রাজস্ব আহরণ কমেছে। কর-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে নিচে-মাত্র ৭.২%। সরকারের আয় নেই, বিনিয়োগ নেই, অথচ ব্যয় বাড়ছে। এ এক ভয়াবহ ফাঁদ।
আমাদের সময় : এই সংকট থেকে উত্তরণে করণীয়?
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর : তিনটি বিষয় জরুরি-১. সংবিধান সংস্কার করে একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক রূপরেখা নির্ধারণ করতে হবে; সেটি অবশ্যই নির্বাচনের মাধ্যমে। ২. ভার্টিক্যাল ডেমোক্রেসি অর্থাৎ- তৃণমূলভিত্তিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ৩. নির্বাহী, বিচার বিভাগ এবং সংসদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
আমাদের সময় : প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে কী বলবেন?
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর : শক্তিশালী নির্বাহী বিভাগ গড়ে তুলতে হবে। আমলাতন্ত্রকে এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া নির্বাহী বিভাগের ধাপে ধাপে সংস্কার দরকার।
আমাদের সময় : অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কেমন ধরনের কর্মসূচি প্রয়োজন?
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর : আমাদের দরকার বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বিপুল পরিকল্পনা। শুধু পোশাকশিল্পে নির্ভর করে চলা যাবে না। শিল্পের বৈচিত্র্যকরণ অর্থাৎ- টেকসই রপ্তানি বাজার তৈরি করা খুব জরুরি। দ্বিতীয়ত- কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার আমূল ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের প্রয়োজন ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, রাজমিস্ত্রি; কিন্তু সমাজ এসব পেশাকে সম্মান করে না- এ মানসিকতা পাল্টাতে হবে। তৃতীয়ত- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা দিতে হবে। সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে একাডেমি এবং ইন্ডাস্ট্রির সংযোগ জরুরি হয়ে পড়েছে; আমাদেরও সেই পথেই যেতে হবে।
আমাদের সময় : মার্কিন প্রেসিডেন্টের আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ যে দর কষাকষি করেছে, এটাকে কীভাবে দেখছেন? এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারতো?
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর : সাম্প্রতিককালে বিশ্বে বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা চলছে, কেউ কেউ বলছে যুদ্ধাবস্থা। এই যে শুল্কের ব্যাপারটা, এই বিষয়ে আসলে প্রথম যেটা দরকার ছিল সেটি হচ্ছে- রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা। কারণ একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সে চুক্তিতে কী আছে আমরা জানি না। যেটুকু জানি সেটুকু হচ্ছে- হোয়াইট হাউস যা জানিয়েছে; তাহলে এটা তো ভবিষ্যতের জন্য ভালো না। এটা আসলে জানা দরকার ছিল। আমি খুব আশাবাদী মানুষ। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ধরনের প্রসিডেন্ট মেডেল পেয়েছেন। আশা ছিল অনেক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের শুল্ক ৫ থেকে ১০ শতাংশ হবে। তার যে ভাবমূর্তি, তা কাজে লাগাতে পেরেছেন কিনা ঠিক জানি না। তবে আপাতত একটা অস্বস্তি কেটেছে। আমাদের দেখতে হবে যে, কী অবস্থা দাঁড়ায়। যেটি আমাদের বলা হচ্ছে না। আমাদের আসলে মনোযোগ দিতে হবে- বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রে। কারণ আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে অন্য সব দেশের শুল্ক বাংলাদেশ থেকে বেশি; কিন্তু ইতিহাস বলে- ওই সব দেশের অভিযোজন ক্ষমতা অনেক বেশি। মূল কথা হলো- আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
আমাদের সময় : এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব কী হওয়া উচিত?
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর : এই সরকারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব একটাই- একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করা। সরকারকে মনে রাখতে হবে ১/১১-এর সময় ১২২টি অধ্যাদেশ করা হয়েছিল। পরে সংসদে পাস হয়ছে মাত্র ৪৪টি। যেহেতু এখন সংসদ নেই, সুতরাং যেসব অধ্যাদেশ তারা করেছে, সেগুলো করার আগে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার ছিল। কেননা ভবিষ্যতে তো আইনি কাঠামোর দিকে যেতে হবে। আইনি কাঠামো মানে হচ্ছে- নতুন সংসদ যখন আসবে, তখন ৩০ দিনের মধ্যে এগুলোকে পাস করাতে হবে, নয়তো বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের সময় : বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর : আমি খুবই আশাবাদী। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ অধিকার সচেতন। যদি আমরা একে সঠিক নেতৃত্ব, ন্যায্য সমাজব্যবস্থা এবং বাস্তবভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দিতে পারি, তবে বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনার দেশ হয়ে উঠবে। আমরা শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইশতেহারে গুণগত পরিবর্তন চাই- যাতে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা পর্যন্ত সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।