কমানো শুল্ক এবং আমাদের ক্ষণিকের স্বস্তি

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী
০৬ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কমানো শুল্ক এবং আমাদের ক্ষণিকের স্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন প্রশাসন মার্চ-এপ্রিল, ২০২৫ সালে বিশ্ববাণিজ্যে এক চরম প্রতিকূল প্রেক্ষাপটে ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নীতি ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সফলভাবে তার ওপর বসানো যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ৩৭% থেকে ৩৫% এবং তারপর ২০%-এ নামিয়ে এনেছে। যদিও এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি সই হয়নি বাংলাদেশের। তবে আশা করা যায়, এই মাসেই এই চুক্তিটি সম্পন্ন হয়ে যাবে।

আমাদের রেডিমেড গার্মেন্টের জন্য এই চুক্তিটি একটা স্বস্তির জায়গা। আমাদের রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজারে, প্রতিযোগীদের সমান (ভিয়েতনাম ২০%) বা তার চেয়ে কম (চীন ৩০%, ভারত ২৫%) শুল্কে প্রবেশ করতে পারাটা নিজেদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে বজায় রাখার জন?্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ ছাড়া প্রতিযোগীদের মধ্যে বাংলাদেশের সমান ২০ শতাংশ শ্রীলংকা এবং ১৯ শতাংশ হার নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কমে রয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের হারও ১৯ শতাংশ। তাইওয়ানের ওপর ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের। ভারত (৪৫.৭ বিলিয়ন), ভিয়েতনামের (১১৩.১ বিলিয়ন) তুলনায় আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি বেশ কম।

শুল্ক কমাতে পারটা আমাদের প্রধান উপদেষ্টার মতে ‘এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য’, যার সঙ্গে আমি অনেকাংশেই একমত। যতটুকু চিন্তার বিষয় আছে তা হলো- এই শুল্ক কমানোর জন্য আমাদের ঠিক কি কি বিষয়ে আমেরিকার সঙ্গে একমত হতে হয়েছে। নন-ডিজক্লোজার এগ্রিমেন্টের জন্য আমরা এটা এখনও জানি না। তবে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এই চুক্তি হয়নি।

আমারা এখন পর্যন্ত যা জানি, এই চুক্তির জন্য আমাদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দিতে হয়েছে। এর পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছুটা বেশি দাম দিয়ে হলেও আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাত লাখ টন গম পাঁচ বছর ধরে আমদানি করতে রাজি হয়েছি। ইতোমধ্যে দুই লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। এ ছাড়া ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। তরলীকৃত গ্যাস আমদানি বৃদ্ধি এবং বিমান কেনার ব্যপারেও কথা চলছে।

বড় আমদানির জন্য বড় বৈদেশিক মূদ্রা খরচ করতে হবে বাংলাদেশকে। এটিও বাংলাদেশের ওপর বেশ বড় একটা বোঝা হবে। কারণ এই সময়ে আমাদের অনেক বৈদেশিক ঋণও শোধ করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়া, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এই চুক্তি বেশ অবদান রাখবে।

তাহলে কি এই চুক্তি থেকে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি? মোটেই তা না। বাংলাদেশের জন্য এই চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই চুক্তির পূর্বে ৩৫% হারের আশঙ্কায় অনেক বড় আমদানিকারক যেমন ওয়ালমার্ট তাদের অর্ডার স্থগিত রেখেছিল। এখন ট্যারিফ কমায় তারা অর্ডার পুনরায় চালু করার ইঙ্গিত দিয়েছে, যা বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে বেশ ভালো ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া কারখানাগুলো এখন তাদের অর্ডারের নিশ্চয়তা পাওয়ার ফলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো কঠোর পদক্ষেপের দিকেও যাবে না, যা নিঃসন্দেহে আমাদের অর্থনীতির জন্য একটা বড় স্বস্তি। এই শুল্ক কমানো বাংলাদেশের জন্য একটা লাইফ লাইন হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।

শুধু একটা পণ্য এবং তার ওপর বিশাল পরিমাণে নির্ভরশীলতা আমাদের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সক্ষমতার জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের পণ্য ডাইভার্সিটিফিকেশনের দিকে নজর দিতে হবে, একই সঙ্গে বাজার ডাইভার্সিফাইও করতে হবে। যেমন- ছোট যন্ত্রাংশ, মোটর পার্টস, ফ্যান, রিফ্রিজারেটর, সার্কিট বোর্ড ইত্যাদি উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি আমরা। আমাদের ওয়াল্টন, মার্সেল, মিনিস্টারের মতো কোম্পানি আছে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে। হালাল সার্টিফায়েড ফুড প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও ইউরোপে বাজার পাওয়া আমাদের জন্য বেশ সহজ। এটার দিকে নজর দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপে এনডিএ এবং জিএনপি অনুমোদন বাড়িয়ে উচ্চমূল্যের জেনেরিক ওষুধ রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব। আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর সেই সক্ষমতা আছে।

এই মুহূর্তে আমরা আপাতত এই কূটনৈতিক বিজয় নিয়ে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারি, নন-ডিজক্লোজার এগ্রিমেন্টের কবলে থাকা এই চুক্তি দেশের স্বার্থ অক্ষুণœ আছে বলে আশা করতে পারি এবং নিজেরা এই স্বস্তির সময়টুকুতে বর্তমান ব্যবসার মুনাফার টাকা দিয়ে নতুন পণ্যের নতুন বাজার খুঁজে সেখানে ব্যবসা বিস্তার করে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক অবস্থা তৈরিতে কাজ করতে পারি। শুধু যদি আমরা চামড়াজাত পণ্যের কথা চিন্তা করি, তাহলে রপ্তানি আয়ে আরএমজির পরই অবস্থান। তবে পর্যাপ্ত পরিবেশ সনদ না থাকায় ইউরোপীয় বাজারে ঠিকমতো ঢুকতে পারছি না। নিজেদের ব্র্যান্ড বানাতে পারছি না দেশের বাইরে। অথচ এই খাতে কিছুটা নজর দিলে এটি বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটা বেশ বড় জায়গা হয়ে উঠতে পারে।

এটা করা আসলে আমাদের জন্য কোনো অপশন না। এটা করা আমাদের অর্থনৈতিক অস্তিত্বের জন্য অত্যাবশ্যক। সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীদেরও কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে দেশের স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমরা ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের কিছুটা সুরক্ষিত করতে পারব।


রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ফিনটেক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি