জুলাই বিপ্লবের অকুতোভয় অংশীজন ইউট্যাব
বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যুগে যুগে জাতিকে পথ দেখিয়েছে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে, ক্রান্তিকালে দেশের হাল ধরেছে। এখান থেকে গড়ে ওঠা সব আন্দোলনই সফল হয়েছে। চব্বিশের গণবিপ্লব সর্বশেষ উদাহরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় চব্বিশের জুলাইয়ে যে বীজ উপ্ত হয়েছিল, আগস্টের ৫ তারিখে তা ফুলে-ফলে সুশোভিত বৃক্ষে রূপ নেয়। দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় এ দেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা।
সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই থেকেই রাজপথে গড়ে ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন। কে জানত এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ফ্যাসিস্ট পতনের বীজ, হাসিনা খেদাও আন্দোলন; কোটা সংস্কার রূপ নেবে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নামে এক অনবদ্য অভিযাত্রায়! শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক এ আন্দোলন শুরু থেকেই ছিল গোছানো ও পরিকল্পিত। প্রতিদিনের কর্মসূচিতে ছিল ভিন্নতা। ছিল দূরদর্শী নেতৃত্ব। এ কারণেই আন্দোলন ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নজর ছিল। আগ্রহও ছিল। বলা যায়, সক্রিয় ছিল শিক্ষক সমাজ। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের একটি বড় অংশ সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। তারা কখনও রাজপথে থেকে শিক্ষার্থীদের সাহস জুগিয়েছেন, কখনও বুদ্ধি-পরামর্শসহ নানাভাবে হয়েছেন আন্দোলনের সারথি। এ ক্ষেত্রে ‘ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাবের)’-এর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে সরব ও সুসংগঠিত।
ইউট্যাব দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরেই জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছিল। বিএনপিসহ বিরোধীমত দমনে হাসিনা সরকারের দমন-পীড়নের কঠোর সমালোচনা, প্রতিবাদ এবং রাজপথে নানা কর্মসূচি দিয়ে দেশব্যাপী গড়ে তোলে আন্দোলন। এর সর্বশেষ পর্যায় ছিল চব্বিশের জুলাই-আগস্ট।
পৃথিবীর আদিকাল থেকেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরক। একটি আত্মিক সম্পর্ক। কালে কালে, যুগে যুগে সব দেশেই সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি একই রকম। সক্রেটিস থেকে শুরু করে শেখ সাদী কিংবা আধুনিককালের শিক্ষকরাও সম্পর্কের এই রসায়ন রপ্ত করেন। বলা যায়, অনেকটা চুপিসারে, মনের অজান্তে এই মধুর অথচ শক্তিশালী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। চব্বিশের উত্তাল দিনগুলোয় সম্পর্কের সেই পুরনো রসায়ন চোখে পড়ে। কেননা, শ্রেণিকক্ষে যে শিক্ষার্থীকে সততা, ন্যায় বা দায়িত্বের প্রতি সজাগ-সচেতনতার সবক দেন শিক্ষকরা, সেই শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে অরক্ষিত হয়ে পড়ে, তখন তাদের সুরক্ষার বিষয়টি প্রধান হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষকদের কাছে। সমাজ সংস্কারের প্রধান গুরু শিক্ষক। তাদের দায়িত্ব শুধু শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে পথ বাতলে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ন্যায্য-অনায্য বুঝতেও সাহায্য করা, জীবনে পরিপূর্ণ গাইডলাইন দেওয়া, সত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। চব্বিশের আন্দোলন একটি ধ্রুব সত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। শিক্ষকদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। ইউট্যাব এই কঠিন সত্যটি উপলব্ধি করেই সাধারণ ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়িয়েছিল; সংকটে তাদের একা করে যায়নি। সংঘাতে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বুলেটের মুখোমুখি হয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আন্দোলনের একেকটি দিন ছিল একেকটি বিভীষিকাময় অধ্যায়। ইউট্যাব তার সব শক্তি দিয়ে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার কিংবা শাহবাগ থেকে ভিসি চত্বরÑ সবখানে পুলিশের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আগলে রেখে তাদের শক্তি, সাহস আর অনুপ্রেরণা দেয় ইউট্যাব।
৫ আগস্ট। দেশজুড়ে কারফিউ। সকাল থেকেই থমথমে রাজধানী। নিরাপত্তা রক্ষীর রক্তাভ চোখ। আগ্রাসী পুলিশ। হাতে মারণাস্ত্র। সেনাবাহিনী, বিজিবির সাঁজোয়া যান, তাক করা রাইফেল, কালো পোশাকি র্যাবের ভয়ানক মহড়াÑ সব মিলিয়ে ভীতিকর পরিবেশ। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জড়ো হন ইউট্যাবের শিক্ষকরা। প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম ও মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের নেতৃত্বে শিক্ষকরা প্রথম কারফিউ ভাঙে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের নেতৃবৃন্দ। বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগ পর্যন্ত এগিয়ে গেলে পুলিশ বাধা দিলেও শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে সেদিন দাঁড়াতে পারেনি হাসিনার পুলিশ।
ইউট্যাবের সেদিনের সেই কারফিউ ভাঙার দৃশ্য মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজধানীজুড়ে কারফিউ ভাঙার হিড়িক পড়ে যায়। গুটিয়ে যায় হাসিনার নিরাপত্তাবেষ্টনী। অলিগলিতে থাকা লাখ লাখ মানুষের লক্ষ্য ফ্যাসিবাদের ক্যান্টনমেন্ট গণভবন। জনস্রোত সেদিকেই ছুটতে থাকে। এর পর একটি কাক্সিক্ষত বিজয়। দুুপুরের পরপর হেলিকপ্টারে করে দিল্লি পালিয়ে যান চব্বিশের গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে ইউট্যাবের। যে আন্দোলন ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য, যে আন্দোলন ছিল একটি বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য, সাধারণ শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অংশ হতে পেরে ইউট্যাবের প্রত্যেক সদস্য গর্বিত। এ গর্ব এ দেশের প্রতিটি বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষকের। কেননা, শিক্ষকরাই একটি সমাজ ও দেশ গড়ার সত্যিকারের সৈনিক।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মোর্শেদ হাসান খান : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়