অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

শামীমা সুলতানা
০৫ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ এক অপার স্বপ্ন ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক দল ও জনগণের সুদৃঢ় ঐক্যের মধ্য দিয়ে একটি কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার বিশাল সুযোগ তৈরি হয়েছে। ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের জনতার অভূতপূর্ব বিজয় সূচিত হয়েছে। ভাবতে ভালো লাগে এ আন্দোলনের সঙ্গে আমিও শুরু থেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম এবং দৃঢ়ভাবে ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করিনি। ছাত্রজীবন থেকেই আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো ন্যায্য আন্দোলনে অগ্রভাগে থাকতে পিছপা হইনি। দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা আমার চলার পথের পাথেয়। সেই দায়বদ্ধতা থেকে জুলাই আন্দোলনে আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আগে থেকেই আমি সোচ্চার ছিলাম। জুলাই আন্দোলন তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। জুলাই আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ছবি অফিসকক্ষ থেকে নামিয়ে ফেলার পর আমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হতে থাকে। কিন্তু আমি সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করিনি। সময়ের প্রয়োজনে আমি প্রয়োজনীয় ঝুঁকি নিয়েছিলাম। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে সর্বদা প্রস্তুত।

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল ও জনগণের ঐক্য সবচেয়ে জরুরি। কারণ আমরা যদি নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও বিভাজন সৃষ্টি করি তাহলে মূলত লাভবান হবে পতিত স্বৈরাচারী শক্তি। তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে যে কোনো সময়। জুলাই আন্দোলন কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর নিজস্ব ফসল নয়। বরং সমগ্র জাতির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও ত্যাগের ফসল। সব শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ ও সব বয়সের মানুষ জুলাই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এমনকি শিশুরাও তাদের সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য রাস্তায় নেমেছিল। এখন পুরো জাতি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখার জন্য উন্মুখ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হবে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। কারণ ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে দেশ নানা ধরনের জটিলতায় পর্যবসিত হবে। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা আরও সুদৃঢ় করা দরকার এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। গত ষোলো বছর মানুষ ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থেকে মানুষকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এখন সময় এসেছে গণমানুষের কাক্সিক্ষত মূল্যায়ন করার। মানুষকে তাদের ভোটের সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এ দেশের মানুষের কাছে ভোট একটি উৎসবের নাম। কিন্তু ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার ভোটকে আতঙ্কে রূপান্তরিত করেছে। এ দেশের মানুষের জন্য আবার ভোট উৎসবের পরিবেশ তৈরি করে সরকার গঠনে তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।

নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের মধ্য দিয়ে জনগণের মতামত প্রতিফলনের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে স্বৈরাচার জন্মের দ্বার বন্ধ করা সম্ভব হবে। কারণ বিগত ষোলো বছর ধরে প্রহসনের নির্বাচন ও রাতের ভোটের মধ্য দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তি ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। তাই জনমতের ভিত্তিতে যদি সরকার গঠন করা যায়, যদি জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায় তাহলেই কেউ স্বৈরাচার হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে না। কিন্তু আমরা যদি ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে বিভেদের রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকি তাহলে লাভবান হবে পতিত স্বৈরাচার। আমরা যেন ভুলে না যাই বিগত ষোলো বছরের সীমাহীন অত্যাচার, অবিচার ও নিপীড়নের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও তাদের অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মী এবং স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ ও গুপ্তঘাতক বাহিনী যে নৃশংসতা চালিয়েছিল তা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। পাখির মতো গুলি করে নিরপরাধ মানুষ হত্যার পাশাপাশি হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারী ও নিষ্পাপ শিশুদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে। স্বয়ং শেখ হাসিনার নির্দেশেই যে এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। বিবিসিসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণেও ঘটনার সত্যতা বিশ্বের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে।

এমনকি স্বৈরাচার হাসিনা যখন পদত্যাগ করেছেন তখনও সাভার এলাকায় স্বৈরাচার বাহিনী হত্যা অব্যাহত রেখেছে। সেদিন সাভারে শ্রাবণ, আলিফ, সাফুয়ানসহ অসংখ্য নাম না জানা মানুষকে হত্যা করা হয়। ৫ তারিখের পর ভ্যানে করে পোড়ানো কতশত লাশ আমরা দেখেছি নানা গণমাধ্যমে। আমি জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি, আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করি। সেই সঙ্গে নিহত ও আহতদের তালিকা এবং তাদের প্রতি সরকার যেন যথাযথ দায়িত্ব পালন করে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করি। বৈষম্য দূর করার যে স্বপ্ন নিয়ে আমাদের স্বপ্ন সারথিরা রাস্তায় নেমেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণ হোক।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল অভাবিতপূর্ব। তাই সাধারণ মানুষের আশা কাক্সিক্ষত বাস্তবায়ন জরুরি। নারী তার শক্তি ও সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। নারীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি আন্দোলনে গতিসঞ্চার ও সাধারণ মানুষকে একতাবদ্ধ করতে অবিশ্বাস্য ভূমিকা রেখেছিল। নারীর ন্যায্য অধিকার ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। জুলাই আন্দোলনে নারীদের প্রতিরোধ ও নারীর ওপর সহিংসতার ছবিগুলো পুরো দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছিল বলেই আন্দোলনে সাধারণ মানুষ জড়িয়ে পড়েছিল। সাধারণ মানুষের চাওয়াও খুব বেশি নয়। তারা শান্তিতে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চায়। অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। মানুষ এখন জান-মাল এবং সম্মানের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এমনকি এখন মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায়। এত অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধেও সরকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা জরুরি। বিগত ষোলো বছরে শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদী সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের মহোৎসবে মেতে উঠেছিল। স্কুল থেকে পরীক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে জাতিকে মেধাহীন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তারা। পাঠ্যবই নিয়েও নানা ধরনের দুরভিসন্ধিমূলক কাজে মেতে উঠেছিল তারা। নিজেদের লোকদের দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয়াই ছিল এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য। পাঠ্যক্রমে নানা ধরনের উদ্দেশ্যমূলক বিষয় তারা যোগ করেছিল। ইতিহাস বিকৃতির মধ্য দিয়ে নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যই এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এতে দেশ-জাতির ন্যূনতম কোনো লাভ হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট করে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে রেখেছিল। সহিংসতার কারণে অনেক নিরীহ ছাত্রছাত্রী জীবন হারিয়েছিল। স্বৈরাচারী শাসনকে অব্যাহত রাখতে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরিতে ছাত্রলীগকে দানবে পরিণত করা হয়েছে। গত ষোলো বছরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করে দেশকে পঙ্গু করে দিয়ে গেছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থা, সাংবাদিকতা, আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিয়েছে পতিত স্বৈরাচার। এগুলো মেরামত করা জরুরি। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মধ্য দিয়ে আগামীতে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তাদেরকে এসব বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ দেশের মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাদেরকে আরও বেশি অধিকার সচেতন হয়ে উঠতে হবে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতায় স্বৈরাচার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এদেরকেও সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে হবে। দেশের প্রকৃত মালিক এ দেশের জনগণ। শাসকশ্রেণিকে এ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না। তাই জনগণের মতামতের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। শাসকদের মতামতকে জনগণের মতামত বলে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জনসমর্থন ছাড়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চিন্তা করলে জনগণই একসময় তা প্রতিহত করতে রাজপথে নেমে আসে। তাই সব কাজের ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণিকে জনগণের কথা মাথায় রাখতে হবে। জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে কাজ করলেই সম্ভব হবে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণ।


অধ্যাপক ড. শামীমা সুলতানা : সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়