অভ্যুত্থান কি কোনো ভোজসভা

নাহিদ হাসান
০৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অভ্যুত্থান কি কোনো ভোজসভা

৪ মে থেকে দূরত্বভিত্তিক রেয়াত বাতিলের বছর পূর্তি হলো। কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার ট্রেনের ভাড়া শোভন চেয়ারে আগে যেখানে ছিল ৫০৫ টাকা, তা হয় ৬৮৪ টাকা, স্নিগ্ধা ৮৮৪ থেকে বাড়ে ১২২৫ টাকা আর এসি বার্থ ১৭শ থেকে ২২৭৫ টাকা। একই অবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটেও। মানে গাজীপুরের লোক যে ভাড়ায় রাজধানীতে আসবে, কুড়িগ্রাম ও কক্সবাজারের লোক সেই ভাড়ায় পারবে না। রাষ্ট্র মানে টাকার মেশিন।

কুড়িগ্রাম থেকে রমনা পর্যন্ত রেললাইন সংস্কারের কাজ চলছে হাসিনার আমল থেকে। উলিপুর থেকে চিলমারীর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের ২২ জানুয়ারিতে, আর কুড়িগ্রাম থেকে উলিপুরের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ৩০ জানুয়ারিতে। উলিপুর থেকে চিলমারী অংশের কাজ শুরুই হয়নি আর কুড়িগ্রাম-উলিপুর অংশে অর্ধেকে এখনও স্লিপারই বসেনি। কবে নতুন লাইন বসবে, পাথর পড়বে, কবে হবে মাটি ভরাটও?

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান বলতে কেবল বুঝেছে, শিল্পকলা একাডেমিকে একটি সংগঠনের হাতে ছেড়ে দেওয়া। আর সারাদেশে বাউল সন্ধ্যা করা। এগুলো সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই হয়। তার জন্য অভ্যুত্থান লাগে না। অভ্যুত্থান লাগে উপজেলায়, হাটে ও বটতলায় জনগণকে যুক্ত করে সাংস্কৃতিক জাগরণে। তখন উপদেষ্টাকে জনগণের কাছে যেতে হয়। এত সময় কোথায়!

সাগর থেকে তেল-গ্যাস সংগ্রহের উদ্যোগ নেই। জ্বালানিতে হাসিনার নীতিই বহাল। রেল কারখানাও তথৈবচ। হাট-ঘাটের ইজারা বাতিলের আলাপই নেই। ৬০-৭০ শতাংশ কৃষকের পণ্যের দাম কীভাবে নির্ধারিত হবে? ইলিশ ছাড়াও পৈরালি, বাঘাইড়, পাঙ্গাশ যে মাছ, সেই মাছের বংশ বৃদ্ধির জন্য নদনদীর কোলা রক্ষার উদ্যোগ আর কবে হবে? ফরিদা আপাও ইলিশ ছাড়া আর কোনো মাছ চিনলেন না।

পরিবেশ, আইন ও আইসিটিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এই তিনটিতে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ হয়েছে। শিক্ষায় রাখাল রাহার অবদান স্পষ্ট। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সবাই মোটামুটি সন্তুষ্ট।

দুই

বিসিএসে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার হিসেবে না রেখে এ দুই ক্যাডারকে আলাদা করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারটা অযৌক্তিক। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা আলাদা। আমরা সুপারিশ করছি, এটি ক্যাডার রাখা যাবে না। যেমন একজন চোখের ডাক্তার, একজন দাঁতের ডাক্তার, আরেকজন জেনারেল ফিজিশিয়ান- পদোন্নতি কি তারা একসঙ্গে পাচ্ছেন? পাচ্ছেন না। সেজন্য আমরা বলেছি, এটা ক্যাডারে রাখা যাবে না। এগুলোকে আলাদা করতে হবে। বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হোক, এটা বিশেষায়িত বিভাগ। এই দুই বিভাগ ছাড়া বাকি সবই ক্যাডার থাকতে পারবে।’

এ সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘পিএসসি থেকে সরে গিয়ে আমাদের জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন আলাদা হয়েছে। ঠিক এ রকম আমরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারকে আলাদা করার পরামর্শ দিয়েছি।’

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৩৬ হাজার কর্তাও মাঠে নেমেছিলেন। গত ৪ জানুয়ারি ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর ব্যানারে ঢাকায় সমাবেশও হয়। তার আগে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা কমিয়ে ৫০ শতাংশ করায় তারা কলম-বিরতি দিলেন। তার পর বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা কর্মসূচি দিয়েছেন। সেই সংস্কারের কী খবর, আমরা জানি না। এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, অন্য যে কোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যে কোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন। অধ্যাদেশে এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছে, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে।

সম্প্রতি সরকারি কর্মচারীরা এই অধ্যাদেশের বিপক্ষে নেমেছেন। তারা কোনো সংস্কারই মানবেন বলে মনে হচ্ছে না। তারা নিজেদের পার্টি মনে করছেন। ভাবসাবে টের পাওয়া যায়, আমলারা বর্তমান সরকারকে নয়, সামনের সরকারে যারা আসছেন তাদের প্রতিই অনুগত। জজদের মতো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগেও আলাদা পরীক্ষা নেওয়া হবে, বেতনও বাড়বে, তবু তারা রাজি নন। শিক্ষকরা, ডাক্তাররা অফিসার হতে চান। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এত সাহস কেমনে মিলল? অভ্যুত্থানের আগের আর পরের পরিস্থিতি সমান? ১৪শ শহীদ আর অর্ধলক্ষের পঙ্গুত্ব বরণ মাগনা? আহমদ ছফা লিখেছিলেন, আমলারা নিজেরাই একটা পার্টি। কারণ সরকার যায় সরকার আসে, তারা থেকে যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো। আমলারা কিছুই বদলায়নি।

১৮৮৫ সালে একজন ব্রিটিশ আমলার নেতৃত্বে কংগ্রেস গড়ে উঠল। একইভাবে মুসলিম লীগও। আমলারা ঠিক করলেন রাজনীতিবিদরা কেমন হবেন। তার আগে বাংলা ও ভারতজুড়ে যে কৃষক বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার লড়াই হয়েছে, সেগুলোর নেতারা ছিলেন এই ভূখণ্ডের উপযোগী। নেতারা ছিলেন মূলত কৃষকই। আওয়ামী ১৬ বছরে আমলারা এমপি নির্বাচন করেছেন। ডিসিরা ১৮ সালের পর বলতেন, তারা এমপিদের বানিয়েছেন। ’২৪-র গণ-অভ্যুত্থানের পর সংস্কার প্রস্তাবগুলো আমলারা মানতে পারছেন না।

এম আর আখতার মুকুল ‘মুজিবের রক্ত লাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, কাস্ট্রো নাকি শেখ সাবকে বলেছিলেন, ‘কেননা, আপনি বাংলাদেশে একটা পরাজিত প্রশাসনকে আইনসঙ্গত করেছেন। এক্সেলেন্সি, আপনি কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন।’

সংস্কার ছাড়া কিছুই বদলাবে না। আমলা নামক পার্টির উচ্ছেদ ছাড়া বদলাবে না কিছুই। আমলারা জানে না, অভ্যুত্থান কোনো ভোজসভা নয়!

নাহিদ হাসান : লেখক ও সংগঠক