ইতিহাস, সংস্কার ও নির্বাচন

রবি রায়হান
০৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ইতিহাস, সংস্কার ও নির্বাচন

পৃথিবী সৃষ্টির লগ্ন থেকেই যুগে যুগে ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। নব-নব সভ্যতার উদ্ভব হয়েছে। ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে আগের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কুসংস্কার, অনিয়ম-দুর্নীতি, অনৈতিকতা, সামাজিক ব্যাধি ও ব্যভিচার দূর করে মানুষের খর্বিত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছে। মানবসভ্যতা ভাঙাগড়া ও বিবর্তনের মাধ্যমে যুগে যুগে মানবজাতি সমৃদ্ধি লাভ করেছে এবং মানবসভ্যতার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার রচিত হয়েছে। যেমন ইতিহাস সাক্ষী আন্দোলন ও বিপ্লবের মাধ্যমে মধ্যযুগে সামন্ত প্রভুদের নিষ্পেষণের কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল মধ্য ইউরোপের ভূমিদাস কৃষককুল। ইতিহাস সর্বদা নির্মম সত্য বুকে ধারণ করে চলে যুগের পর যুগ। ইতিহাস পাল্টে ফেলা যায় না, ভাঙাগড়ার খেলা শেষ হলে স্বমহিমায় সত্য বুকে ধারণ করে ফিরে আসে বারবার। ইতিহাস বিকৃত করে মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করা যায় না, হয়তো কিছু সময় মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানো যায়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিজের একান্ত কিছু মানুষের বেইমানিতে পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করে নেয়। তার পর ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে জমিদারি প্রথা চালু করে। তাদের অনুগত লোক দিয়ে দেশের বেশির ভাগ ভূমির মালিকানা তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সাধারণ প্রজাদের রায়তি বানিয়ে দেয়। সে কারণে অখণ্ডিত ভারতবর্ষে জমিদারি ব্যবস্থার প্রচলন বিস্তার লাভ করতে থাকে। যুগে যুগে অত্যাচারিত হয়ে ভূমিহীন প্রজাসাধারণ জমিদারদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে। দুইশ বছর ইংরেজ শাসনকালের শেষ ভাগে এসে তৎকালীন অখণ্ডিত ভারতবর্ষের মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বাংলার সাধারণ জনগণকে এ মর্মে বোঝাতে সক্ষম হন যে, ব্রিটিশ বেনিয়াদের আন্দোলনের মাধ্যমে বিতাড়িত করতে পারলে এবং এ দেশের জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সেই সরকার জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে সব জমির রায়তদের যার যার দখলীয় ভূমির মালিকানা তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে, সে ধারাবাহিকতায় আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের কবল থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। ধর্মীয় দিক বিবেচনায় দুটি রাষ্ট্র হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান গঠিত হয়। পাকিস্তান দুটি অংশ নিয়ে গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। ওপরের ইতিহাস সবারই জানা তবুও আজকের আলোচনার স্বার্থে পাঠকদের পুনরায় মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য উল্লেখ করা হলো। অধিকার আদায়ে বাংলার জনগণ কোনোদিনই পিছপা হয়নি। ১৯৫২ সালে রফিক, শফিক ও বরকত বুকের রক্ত ঢেলে রাজপথ রঞ্জিত করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। একই দেশের নাগরিক হয়েও বাঙালি জাতি বৈষম্যের শিকার হয়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশটাকে স্বাধীন করেছে বীর বাঙালি। এই জাতিকে লাল-সবুজের পতাকা এনে দিয়েছে, আরও দিয়েছে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত জাতীয় সংগীত। সেই বীর জাতিকে শাসকগোষ্ঠীর অধিকার বঞ্চিত করে রাখা সহজসাধ্য কাজ হবে না এটাই স্বাভাবিক। বাঙালি জাতি অধিকার আদায়ে সর্বদা অগ্রগামী। প্রথমে শাসককুল জনগণের সেবক হওয়ার ওয়াদা করে ক্ষমতার মসনদে বসে, সেবক যখন দিনে দিনে একনায়ক শাসকে পরিণত হয় তখন জনগণের সব অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়। রাজা-প্রজার সম্পর্ক তৈরি করে। প্রজাদের সুখ-শান্তি রাজার কাছে গৌণ হয়ে ওঠে। একনায়ক শাসক ক্ষমতার দম্ভে চাটুকারদের নিয়ে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে পড়ে। রাজ্যের প্রজাদের খোঁজখবর রাখে না। প্রজাদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। চাটুকারদের তোষামোদীর বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে একনায়ক শাসক দিনে দিনে প্রজাসাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে। চাটুকারদের দুর্বিষহ অত্যাচারে জর্জরিত প্রজারা রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে। ক্রোধান্বিত প্রজারা মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ বুঝে রাজার বিরুদ্ধে, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

রাজাকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতার মসনদ থেকে নামিয়ে দেয়। কোনো সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে স্বৈরাচারী আচরণ করতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের সঙ্গে ঠিক রাজা ও প্রজার শাসন কায়েম না করলেও দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে একনায়কের চরিত্রের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে শাসককুলের মনে অহমিকার জন্ম নিয়েছিল। তারা ভাবতে শুরু করেছিল তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী। তারা ভুলতে বসেছিল এই দুনিয়ায় ক্ষমতা ও অর্থ কারও চিরদিন থাকে না। হাতবদল হতেই থাকে এবং এটাই ধ্রুব সত্য। আওয়ামী লীগের মতো একটা বিশাল জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলের সরকার আন্দোলনে তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে। ভবিষ্যতে যে দলই ক্ষমতার মসনদে বসুক না কেন। আওয়ামী লীগের করুণ পরিণতির ইতিহাস তাদের স্মরণ থাকলে তাদের এবং জনগণের উভয়ের জন্যই মঙ্গল হবে।

বর্তমানে দেশে মব জাস্টিস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সব বিষয় জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, গার্মেন্টস সেক্টরে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সেসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে সংস্কার করতে হবে। তবে সংস্কার করলেই যে তা টিকে থাকবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই, কারণ সব সংস্কার সংসদে পাস হতে হবে। যা নির্বাচিত সরকারের এখতিয়ার। রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে, অনৈতিকতা মানুষের অন্তরে বিষবাষ্পের মতো সর্বদা ধূমায়িত হয়। যার অর্থ সম্পদ আছে সে অন্যায় করলেও সমাজের বেশির ভাগ মানুষ অন্যায়কারীর পক্ষ নেয়, পক্ষান্তরে দুর্নীতির পক্ষ অবলম্বন করে।

সামান্য কথা কাটাকাটির বিষয়কে কেন্দ্র করে মানুষকে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করছে। বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয়ে গেছে, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করছে।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এটুকুই বলতে হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে সম্মান জানানোই হবে একমাত্র বুদ্ধিমানের কাজ।


রবি রায়হান : কবি ও কলাম লেখক