বছর শেষ হয়ে এলো, তবু বিচার হলো না
দিন কয়েক আগে রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে গিয়েছিলাম। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এলাকায় শহীদের নামসংবলিত একটি ফলক। ইট সিমেন্টের দেয়াল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সস্তা টাইলস দিয়ে দেয়ালটি ঢেকে রাখা হয়েছে। কাছে গিয়ে দাঁড়ালে চোখে পড়বে সারি সারি নাম। ৫৮ জন শহীদের নামের তালিকা। যারা চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন। দ্বীন ইসলাম, রেজাউল করিম, জাহাঙ্গীর আলম, পারভেজ মিয়া, সোহেল রানা, শওকত চন্দ্র দে, রাসেল মিয়া- থোকা থোকা এমন ৫৮ জনের নাম। স্থানীয় রাজমিস্ত্রিদের হাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত নির্মিত এই ফলকের সামনে দাঁড়িয়েই কথা হয় দুই শহীদ পরিবারের সঙ্গে। এই দুই পরিবারেই চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের আগে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তাদের সন্তানরা মিছিলে যোগ দিয়েছিল। পুলিশের টিয়ারশেল আর গুলির বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এখন তাদের চোখে-মুখে সন্তান হারানোর শোকের চিহ্ন ক্ষয় হয়ে আসছে। তাদের মুখের দিকে তাকালে মনে হবে জিজ্ঞেস করি, ‘এই যে অপেক্ষা করে করে তুমি ক্যালেন্ডারের পাতা ঝরালে/আকাশের রঙ পাল্টে দিলে, তবু তোমার অপেক্ষা ফুরালো না/শেষ হলো না তোমার চেয়ে থাকা, তোমার কান পাতা?’ (কোটি বর্ষ অপেক্ষা, মহাদেব সাহা)
২.
প্রায় দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছিল গত বছরের ৫ আগস্ট। বছর ঘুরে আবারও আগস্ট এসেছে। এরই মাঝে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবও অনুমোদন দিয়েছে। যাতে ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে। উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। এই সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।
উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা স্মরণ করতে পারি- আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে টানা কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীসহ ছাত্র-জনতা।
গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের আওতাধীন অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় গত বছর ৫ আগস্ট। গণ-অভ্যুত্থান দমনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে মামলা হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণহত্যা ও আওয়ামী লীগের শাসনের সময়ে গুমের অভিযোগগুলোর বিচারের উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এ জন্য গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে সরকার। এখন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশের বিধান রেখে এ আইনের সংশোধনীর খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এটা গেল আইনি ও বিচারের কথা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- ২০২৪ সালের জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও নির্দেশদাতারা কীভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো? জুলাই হত্যাকারীদের সমর্থকরা এখনও বিভিন্ন সেক্টরে রয়ে গেছে। যদি না থাকত, তাহলে খুনিরা পালিয়ে যেতে পারত না। আইন করে বিচারের বিধান করা হয়েছে, কিন্তু নির্দেশদাতারা সাজা থেকে বেঁচে যাবে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন? এখন স্বাভাবিকভাবেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনুপস্থিতিতে বিচার হবে। ট্রাইব্যুনাল রায় দেবেন। কিন্তু তাদের (জড়িত-নির্দেশদাতা) সত্যিকার অর্থে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না, এটি মেনে নেওয়া যায় না। বিচারে রায় হলে কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তি সাজা পাবে, তবে বেশির ভাগই শাস্তির বাইরে থেকে যাবে। ফলে বিচারের এই দিকটি নিয়ে ভাবতে হবে। এটা নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- এমনটা আমরা জানি না।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট ২০২৪ অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। গণ-অভ্যুত্থান এবং বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তির প্রাক্কালে আমরা যদি পেছনে ফিরে তাকাই, তাহলে চব্বিশের খুনিদের বিচারের প্রশ্নে খুব আশাবাদী হতে পারছি না। এ সময়ে যতগুলো মামলা হয়েছে, তার বিপরীতে আটক গ্রেপ্তারের সংখ্যা হতাশাজনক। আবার অভিযোগ আছে মামলার নিরপেক্ষতা নিয়ে। এমন সব মামলার কথা জানা যাচ্ছে- যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এতে করে মূল অপরাধীরা থেকে যাবে বিচারের বাইরে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে জাতীয় স্বার্থের জায়গায় কাজ করতে হলে এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দল এবং বর্তমান সরকার উভয়ের আরও আন্তরিক হতে হবে।
৩.
যাত্রাবাড়ীতে শহীদের নামের ফলকের সামনে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছিলাম, তখন এক শহীদের ভাই এসে দাঁড়ালেন বাবার পাশে। শোকের চিহ্ন ফুরিয়ে আসা বাবা তখন সন্তানের হাত মুঠোবন্দি করে ধরলেন। হারানো পুত্রের শোক উথলে উঠল বুঝি! ভাই হারানো বালক তখন বলে উঠল- বাজান আর ঢাকাত থাকুম না। বাড়িত যামু।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
৪.
‘এবার হয়েছে সন্ধ্যা। সারাদিন ভেঙেছো পাথর/পাহাড়ের কোলে/আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে/তোমারও তো শ্রান্ত হলো মুঠি/অন্যায় হবে না- নাও ছুটি/বিদেশেই চলো/যে কথা বলোনি আগে, এ বছর সেই কথা বলো।’ (এবার হয়েছে সন্ধ্যা, শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
এহ্্সান মাহমুদ : নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের সময়; কথাসাহিত্যিক
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!