শৃঙ্খলার শিক্ষা
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, আর এর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ইবাদত। নামাজ বা সালাত ইসলামের দ্বিতীয় রুকন, ইমানের পরেই যার স্থান। নামাজ কেবল আনুষ্ঠানিক ইবাদতই নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার মৌলিক উপাদানও বটে। কোরআন ও হাদিসে বারবার নামাজের আদেশ এসেছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শুধু আত্মিক প্রশান্তি বা আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায়ই নয়, এটি একজন মানুষকে শৃঙ্খলাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং জবাবদিহিতার চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলে। এ কারণে বলা যায়, নামাজ মানুষকে আদর্শ নাগরিক, দক্ষ কর্মী ও নৈতিকতাসম্পন্ন চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
নামাজ মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতার এক বাস্তব প্রশিক্ষণ। বিশ^জুড়ে কোটি কোটি মুসলমান প্রতিদিন নির্ধারিত পাঁচটি সময়ে নামাজ আদায় করে, এই একতা ও সমন্বিত শৃঙ্খলাই মুসলিম সমাজকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। এমনকি একজন ব্যক্তি যদি ব্যক্তিগত জীবনে বিশৃঙ্খল ও অগোছালোও হয়, নিয়মিত নামাজ আদায় করতে করতে তার ভেতরে এক ধরনের শৃঙ্খলা ও সময়বোধ সৃষ্টি হয়। এ জন্যই বলা হয়, নামাজ মানুষকে সময়ের মূল্য শেখায় এবং তার জীবনকে একটি সুশৃঙ্খল কাঠামোয় নিয়ে আসে।
নামাজের মাধ্যমে মানুষ নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। এতে তার অন্তরে জাগ্রত হয় ইমান ও জবাবদিহিতার চেতনা।
নামাজে দাঁড়ানোর সময় একজন মুসলমান বুঝে নেয়, ‘এখন আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়েছি’, সে নিজের সব চিন্তা, ব্যস্ততা ও দুনিয়ার কাজকর্ম থেকে দূরে সরে এসে একান্তভাবে রবের সামনে নিবিষ্ট হয়। এই প্রশিক্ষণ একজন মানুষকে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের জন্য প্রস্তুত করে। যে ব্যক্তি রোজ পাঁচবার আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করে, সে কখনও অন্যের ওপর অর্পিত দায়িত্ব অবহেলা করতে পারে না।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
নামাজ মানুষের অন্তরে আখিরাতের জবাবদিহিতার চেতনা জাগ্রত করে। যখন একজন মানুষ নামাজে দাঁড়ায়, তখন সে কিয়ামত দিবসের কথা স্মরণ করে, যেদিন তাকে তার সব কাজের হিসাব দিতে হবে। এ ভাবনা একজন মানুষকে প্রতিনিয়ত নিজেকে সংশোধন করতে উদ্বুদ্ধ করে। একজন নামাজি মানুষ প্রতিটি কাজ করার আগে ভাবে, ‘আল্লাহ দেখছেন, আমি এর জবাব কীভাবে দেব?’ এই আত্মসমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিই একজন মানুষকে সত্যিকারার্থে সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও সদাচারী করে তোলে।
নিয়মিত নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি তার দৈনন্দিন জীবনযাপনে শৃঙ্খলিত হয়। সে সময়ের মূল্য দেয়, অগ্রাধিকার বুঝে কাজ করে এবং নিজেকে আত্মসংযমে অভ্যস্ত করে তোলে। তার মুখে মিথ্যা থাকে না, অন্যায় ও অসদাচরণ থেকে সে দূরে থাকে। সে জানে, প্রতিটি কাজই একদিন আল্লাহর দরবারে বিচারযোগ্য হবে। এই ভাবনা তার অন্তরে এক অদৃশ্য পর্দা তৈরি করে, যা তাকে পাপের পথে যেতে বাধা সৃষ্টি করে।
নামাজ শুধু ব্যক্তিজীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর প্রভাব সমাজজুড়েও বিস্তৃত। মসজিদে জামাতের মাধ্যমে নামাজ পড়া মুসলমানদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও সহমর্মিতার বন্ধন গড়ে তোলে। সবাই একই কাতারে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদত করে, এতে সামাজিক শ্রেণিবিভেদ দূর হয়। এক কাতারে ধনী-গরিব, নেতাকর্মী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই দাঁড়িয়ে যায়, এই একতা ইসলামি সমাজ গঠনের এক মহান নিদর্শন। জামাতের মাধ্যমে অন্য ভাইয়ের খোঁজখবর রাখা, অসুস্থতা বা সমস্যায় পাশে দাঁড়ানো, এসব সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিও গড়ে দেয় এই নামাজ।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
নামাজ কেবল একটি ইবাদত নয়; এটি ইসলামের মূল চালিকাশক্তি, যা একজন মানুষকে শৃঙ্খলা, দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার পাঠ শেখায়। আজকের সমাজে যখন মানুষ নৈতিক অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তখন একমাত্র নামাজই পারে তাদের আত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে শৃঙ্খলিত ও দায়িত্ববান করতে। এ জন্যই কোরআন-হাদিসে বারবার বলা হয়েছে, ‘নামাজ কায়েম করো’, অর্থাৎ শুধু পড়লেই হবে না, বরং তা কায়েম করতে হবে, অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রভাব বিস্তার করতে হবে। আজকের এই বিশৃঙ্খল ও মূল্যবোধহীন সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও ন্যায়নীতি কায়েম করতে হলে ফিরে যেতে হবে নামাজের ছায়াতলে। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, যেখানেই হোক, নামাজের শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারলেই ফিরে আসবে শান্তি, ন্যায় ও সুবিচার।
মুফতি আ জ ম ওবায়দুল্লাহ : মুহাদ্দিস, ছারছীনা দারুস্সুন্নাত জামেয়ায়ে নেছারিয়া দীনিয়া, নেছারাবাদ, পিরোজপুর
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!