তরুণরাই তৈরি করবে নিজেদের কর্মসংস্থান
বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭২। এর সঙ্গে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণ-তরুণী পাস করছে। অনেকেই পাচ্ছে উচ্চ সিজিপিএ। কিন্তু দেশে এত এত পাসকৃত শিক্ষার্থীর জন্য সেই পরিমাণে কর্মসংস্থান কোথায়? কর্মসংস্থান বলতে আমাদের দেশের পাসকৃত তরুণ-তরুণীর কাছে প্রধান অপশন হলো বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি পাওয়া। এ ছাড়া রয়েছে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগকৃত কিছু পদ, সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু পদ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও প্রশাসনিক পদ। রয়েছে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনজিও ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি। অর্থাৎ চাকরির বাজার খুবই সীমিত কিন্তু চাকরিপ্রার্থী অসংখ্য। আর গুটিকয়েক চাকরি কয়জনের ভাগ্যেই বা জোটে?
সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে মোট সার্টিফিকেটধারী বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কর্মহীন থাকছে প্রায় ৮ লাখের ওপর তরুণ-তরুণী।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গত এপ্রিল মাসের বিশ্ব অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৫ সালের জন্য বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের পূর্বাভাস ৬ কোটি থেকে কমে ৫ কোটি ৩০ লাখে নেমে এসেছে। ফলে চাকরি বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমে ১ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে প্রায় ৭০ লাখেরও কম নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে।
এ ধরনের পরিস্থিতি আমাদের দেশের তরুণদের জন্য কখনও আকাক্সিক্ষত নয়। প্রশ্ন হলো, বর্তমানে কর্মসংস্থানের এ রকম নাজুক অবস্থা সৃষ্টির কারণ কী :
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
১. যদিও শিক্ষার হার বিশ্বজুড়ে বাড়ছে, কর্মসংস্থানে এখনও শিক্ষাগত অমিল রয়েছে। ২০২২ সালে মাত্র ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মীর শিক্ষাগত যোগ্যতা তাদের কাজের জন্য যথাযথ ছিল। ২. রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক। ৩. জলবায়ু পরিবর্তন। ৪. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, নতুন প্রযুক্তি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব বিশ্বজুড়ে কাজের ধরনে পরিবর্তন এনেছে। মাঝারি দক্ষতার চাকরিতে এর প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। ৫. বেসরকারি খাতে দক্ষতাভিত্তিক চাকরির বাজারে বিদেশিরা এমন উচ্চ হারে ঢুকছে, যার ফলে দেশের তরুণরা চাকরির বাজারে ঢুকতে পারছে না। ৬. শিক্ষার সঙ্গে কর্মদক্ষতার সম্পর্কহীন অবস্থা। ৭. আরও একটি বিষয় স্পষ্ট, সেটি হচ্ছে শিক্ষার মান। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিয়ে যারা বের হয়েছে তারা বসে নেই। আবার বিদ্যমান বা ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে যুগের প্রয়োজনে যে ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতার চাহিদা তৈরি হচ্ছে, তা বর্তমানে চালু গতানুগতিক বিষয় ও কোর্সগুলো ঠিকমতো পূরণ করতে পারছে না। ৮. দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই এসএমই খাতের। ফলে তারা অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়, এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় কম। ৯. করোনা মহামারীর পরে বিভিন্ন কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া। ১০. খাতভিত্তিক দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। ১১. রাজনৈতিক অস্থিরতা।
উপরোক্ত অবস্থাগুলো থাকলেও তরুণদের কাজ লাগবেই, নতুবা দেশে তৈরি হবে নানা বিশৃঙ্খলা।
তাহলে এ অবস্থায় করণীয় কী : ১. নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি। ২. সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করা। ৩. তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগ। ৪. অন্তর্ভুক্তিমূলক শ্রমবাজার গড়ে তোলা। ৫. বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ। ৬. রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের জন্য ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের বাইরে কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র তৈরির দিকে মনোযোগী হওয়া। ৭. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘ তাত্ত্বিক আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট কোর্সের পরিবর্তে চাকরির বাজারের উপযোগী কোর্স চালু করা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় এ ধরনের কোর্সে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীর বিজ্ঞানসহ সব বিষয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ মৌলিক যোগ্যতা অর্জন জরুরি হয়ে পড়েছে। ৮. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনয়ন। ৯. চাকরি পরীক্ষায় পদ্ধতি পরিবর্তন। ১০. গতানুগতিক কনটেন্টনির্ভর কোর্সের বদলে গবেষণানির্ভর, প্রয়োগমুখী, সমস্যা সমাধাননির্ভর কোর্স চালু করা সময়ের দাবি। ১১. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার মান ও শ্রমবাজারের দাবি অনুযায়ী শিক্ষার সংস্থান জরুরি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
আমরা জানি, আমাদের মতো দেশে এক-একটি পরিবার তার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয় পাস করার পর একটি চাকরি পাবে- সেই আশাতেই থাকে। চাকরি না পেলে অনেক তরুণের অনেক কিছু করারই স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায়। স্বপ্নভঙ্গের কারণে অনেকে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। আত্মহননের ঘটনাও প্রায়ই ঘটছে। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব তরুণদের চাকরির জন্য সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করে নতুন নতুন চাকরির বাজার তৈরি করা। অন্যদিকে বর্তমান কালের তরুণদেরও শুধু চাকরির দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। এরই মধ্যে দেশে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন, যারা তাদের মেধা দিয়ে সাফল্যের মুখ দেখেছেন। সুতরাং তরুণদের তাদের মেধা দিয়ে নতুন আইডিয়া তৈরি করে কর্ম সৃষ্টি করতে হবে। যুগের পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর গতানুগতিক সাবজেক্ট/বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রির জন্য তরুণদের উন্মুখ হলে চলবে না। তরুণদের কারিগরি জ্ঞান লাভ করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, বর্তমানে কোন কাজের দেশে ও বিদেশে সুযোগ রয়েছে। সেসব বিবেচনা করেই তাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের মতো দেশে এখনও তরুণদের চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত মা-বাবারা আর্থিক সহযোগিতা করে যান। এই কনসেপ্টের পরিবর্তন হওয়া দরকার। কোনো কাজই ছোট নয় মনে করে তরুণরা শিক্ষার্থী অবস্থায় বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে পারে। এই যুগে এসব কাজের ফলে কে কী বলল তা দেখার অবকাশ নেই। প্রয়োজন কাজ-অভিজ্ঞতা-অর্থ উপার্জন- দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা। সারা পৃথিবী এখন উন্মুক্ত। তাই তরুণদের চাকরির আশায় বসে না থেকে নিজেকে বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করতে হবে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে হবে। আজকালকার যুগে যোগ্যতা থাকলে সারাবিশ্বে অনলাইনে জব করা সম্ভব। তাই আজকের তরুণের কর্মসংস্থানের সংকট রিপোর্ট পড়ে বিচলিত হলে চলবে না। এইচএসসি পাসের পর ভেবেচিন্তে তাদের সাবজেক্ট চয়েস করতে হবে। শুধু প্রাইভেট টিউশনি নয়, তরুণদের উপযোগী আরও বহু রকম কাজ রয়েছে, সেসব কাজ খুঁজতে হবে। তাদের মাথায় রাখতে হবে, বিদেশে গেলে তাদের অনেক রকম অড কাজই করতে হতো, তাহলে দেশে নয় কেন? একজন যদি উদাহরণ তৈরি করে তবে অন্যরাও নানা কাজে (সেলসম্যান, রেস্তোরাঁর কাজ, রাইডিং, ফ্রিল্যান্সিং প্রভৃতি) যুক্ত হবে। অবশ্য মানসিকতার পরিবর্তন এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। আরও হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত হবে শিক্ষার্থী অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কারখানায়, ফার্মে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এতে তারা অল্পবয়সেই দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হবে, পরবর্তী সময়ে তারা যখন চাকরিতে প্রবেশ করবে, তখন নিঃসন্দেহে একজন দক্ষ অফিসার হিসেবে পরিগণিত হবে।
সুতরাং এই যুগের তরুণ-তরুণীরা চাকরি নিয়ে চিন্তা করে কাবু হবে না। নিজেকে দক্ষ করে, নিজের মেধাকে পুঁজি বানিয়ে নিজেরাই কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক