শিক্ষা সংস্কার কমিশন কেন হয়নি
২০০৮-এর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১-১২ সাল থেকে তাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদ করে এসেছি। ২০২৪ সালে সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল জুলাই মাসে। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই আন্দোলন চলছিল। এই ক্যাম্পাসে কোনো অন্যায় বা নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে কখনও নীরব থাকিনি। তাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই খোঁজখবর রাখছিলাম। জুলাই মাসের শুরুতেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি সংহতি সমাবেশ করার পরামর্শ দিয়েছিলাম, যাতে আমরা শিক্ষকরা তাদের আন্দোলনে সংহতি জানাতে পারি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গঠন করার পর ১৩ জুলাই তারা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে প্রথম একটি সংহতি সমাবেশ করেছিল। সেই সংহতি সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দিয়েছিলাম এবং শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়েছিলাম।
জাহাঙ্গীরনগর যেহেতু একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, সেহেতু এখানে দল-মত ইত্যাদির বিভাজন থাকা সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি একটি সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, যা হয়তো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া যাবে না। তাদের তো উষ্মা ছিলই, তবে তারা যে আমাদের সঙ্গে ভায়োলেন্টলি কিছু করেছে তা নয়। এই ক্যাম্পাসের সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসার জায়গা আছে। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি এত সাহস পেলাম কোথায়? প্রত্যুত্তরে আমি বলি, এই ক্যাম্পাসের সম্পর্কগুলোই আমার সাহস ও শক্তির উৎস।
১৫ জুলাই রাতে ভিসির বাসভবনে শিক্ষার্থীদের ওপর যখন হামলা হয়, তখন শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে ছুটে গিয়েছিলাম। সেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যা ৭টায় মশাল মিছিল হওয়ার কথা ছিল। সেদিন দুপুর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হামলা হয়েছে। আগের দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আন্দোলনকারীদের দমন করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। ঢাবিতে হামলার পর বুঝতে পেরেছিলাম, সরকারের নির্দেশেই এসব হচ্ছে। আমার আশঙ্কা ছিল, রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও হামলা হতে পারে। সে জন্য শিক্ষার্থীদের বলেছিলাম, তারা যেন রাতে কোনো কর্মসূচি না রাখে। কারণ শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শিক্ষার্থীরা তাদের সন্ধ্যার কর্মসূচি বিকেলে এগিয়ে এনেছিল। কিন্তু বিকেলের কর্মসূচিতেই ছাত্রলীগ হামলা চালায়।
শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসভবনের প্রধান ফটকে অবস্থান করছিল। সেখানে গিয়ে প্রথমেই তাদের সঙ্গে কথা বলি। অতঃপর ভিসির বাসভবনে গিয়ে দেখি, ভিসি তার পারিষদবর্গ (হল প্রভোস্ট, ডিন, প্রক্টরসহ ২০-৩০ জন) নিয়ে বসে আছেন। গিয়ে ভিসি, প্রো-ভিসি ও প্রক্টরকে বারবার অনুরোধ করে বলেছি, ‘দিনের বেলায় শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা হয়েছে, তা হয়ে গেছে। আপনারা এমন ব্যবস্থা নিন যেন রাতে সেটার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আপনার বাসভবনের সামনে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় নেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর রাতে যেন কোনো হামলা না হয়। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করুন।’ কিন্তু তারা আমার কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি।
১৭ জুলাই সিন্ডিকেট ডেকে হল ভ্যাকান্টের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর যখন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ত্যাগে অস্বীকৃতি জানায়, তখন তাদের ওপর পুলিশি হামলা শুরু হয়। বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯/১০টা পর্যন্ত পুলিশের লাঠিপেটা, টিয়ার শেল ও গুলি চলতে থাকে। আহত শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ দেখে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যালের সামনে একটি লাইভে ক্রন্দনরত অবস্থায় বক্তব্য দিয়েছিলাম। সে ভিডিওটি দ্রুতই দেশে ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ওই লাইভ বক্তব্যের মাধ্যমেই সারাবিশ্বের কাছে প্রকাশিত হয়ে যাই, যে কারণেই হয়তো সরকার আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি। এরপর ২৯ জুলাই এক বিক্ষোভ সমাবেশে সারাদেশের খুন ও গুম ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আমি একটি বক্তব্য দিই। বক্তব্যের শেষ অংশে কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কবিতার কয়েকটি চরণ উচ্চারণ করি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাসে কোনো প্রশাসন ছিল না। তখন আমরা নিরাপত্তার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিলাম। কুমিল্লার বন্যায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। সে সময় দেখেছি সমন্বয় কমিটিতে থাকা বৈষম্যবিরোধী সংগঠনের কিছু শিক্ষার্থীর বডি ল্যাংগুয়েজ চেঞ্জ হয়ে গেছে। বৈষম্যবিরোধী সংগঠন ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনকে কোনো প্রোগ্রামও করতে দেবে না বলে তারা ঘোষণা দিল। এটা একটা ফ্যাসিস্ট আচরণ। অথচ আন্দোলনের কঠিন সময়গুলোতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম রাজনৈতিক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২৯ জুলাইয়ের যে বিক্ষোভ সমাবেশে দেওয়া আমার বক্তব্য ভাইরাল হয় সেই কর্মসূচি তো বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর ছিল।
আমাদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হয়তো ফ্যাসিবাদের হাতবদল হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া হয় তাদের সবাইকেই খানিকটা জানি। তাই তাদের কাছ থেকে আমি কখনোই ভালো কিছু প্রত্যাশা করিনি। গত এক বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং এর শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি কী? ক্যাম্পাসে কোনো গুণগত পরিবর্তন কি হয়েছে? সবাইকে পদ-পদবি পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই গণ-অভ্যুত্থানের ফসল বর্তমান সরকার, আমাদের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ করেনি। এটা আমাকে কিছুটা বেদনাহত করেছে। আমাকে পদ-পদবি দিতে হবে অথবা মূল্যায়ন করতে হবে এমন কিছু মনে করি না। কিন্তু দুঃখজনক হলো, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল এই সরকার পুরোপুরি শিক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। এই সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করে দেশে সংস্কারের ডামাডোল চালাচ্ছে। অথচ শিক্ষা সংস্কার কমিশন হয়নি। শিক্ষা বাজেট কমানো, শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর উদ্যোগহীনতা, নিজেদের গা বাঁচাতে বিভিন্ন সংকটে শিক্ষার্থীদের সামনে এগিয়ে দেওয়া, মব ভায়োলেন্সের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি আমাকে হতাশ করেছে। আন্দোলনে যুক্ত নয় এমন অনেককে সরকারে নেওয়া হয়েছে। এসব ব্যক্তি কীভাবে জুলাইয়ের প্রত্যাশা পূরণ করবেন?
আমাদের প্রত্যাশা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। এই আন্দোলনে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গন থেকে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী পুরো আন্দোলনের ক্রেডিট কুক্ষিগত করেছে। ঢাবির ফ্যাসিস্ট ও হাসিনার উচ্ছিষ্টভোগী শিক্ষকরা বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ পেলেন। তাদের ক’জন শিক্ষক এই গণ-অভ্যুত্থানে ছিলেন? অথচ তারা সারাদেশের সবকিছু কবজা করলেন। ফলে ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে। ছাত্র উপদেষ্টাদের পিএসদের দুর্নীতির খবর, ডিসি নিয়োগসহ প্রশাসনিক নানা কিছুতে ছাত্রনেতাদের সংশ্লিষ্টতার খবর, সারাদেশে চলমান চাঁদাবাজি, খুন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ইত্যাদি গণ-অভ্যুত্থানকে ম্লান করে দিয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে ছাত্রদের প্রতিও আর মানুষের আস্থা থাকবে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নয়। তারা শুধু মুখেই জুলাইয়ের কথা বলে। জাকসু নির্বাচন নিয়ে উপাচার্যের যে কালক্ষেপণ, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার যে মিথ্যাচার, একাডেমিক ও পরিবেশবিষয়ক মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে তার যে গড়িমসি এবং তার প্রশাসনের যে দলীয়করণ সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থবির হয়ে পড়েছে। আমাদের প্রথম কাজ ছিল ক্যাম্পাসকে পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক পরিবেশ বা শিক্ষার পরিবেশ কোনো কিছুই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। জুলাই হামলার বিচারকাজ এখনও সঠিকভাবে এগোয়নি।
ব্যক্তি ও দলের চেয়ে দেশ ও দেশের মাটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গত ১৫ বছরে আমরা ভারতপন্থিদের দাপট দেখেছি। এখন আবার পাকিস্তানপন্থিরা জেগে উঠছে। তাহলে আমার দেশের মানুষ কোথায়? দেশের শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমার আহ্বান- এ দেশের মাটি ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘস্থায়ী বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালাতে হবে। শিক্ষার্থীদের বলব, তোমরা ক্লাসে ফিরে যাও, জ্ঞানার্জন করো। ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করো।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বাংলাদেশে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা চাই। মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার আলোকে সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি।
ড. মোহাম্মদ গোলাম রববানী : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
অনুলিখন : আলী হাসান মর্তূজা