চাপ সামলানো নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার সাহস চাই

সানাউল্লাহ সাগর
৩১ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
চাপ সামলানো নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার সাহস চাই

রাষ্ট্র পরিচালনা নিছক প্রশাসনিক দায় নয়, এটি নেতৃত্বের পরীক্ষাও বটে; যেখানে প্রতিটি সংকট, প্রতিটি সিদ্ধান্ত একেকটি নির্ণায়ক মুহূর্ত। রাষ্ট্র পরিচালনার সাফল্য নির্ভর করে সে নেতৃত্ব কতটা সাহসী, কতটা ধৈর্যশীল এবং কতটা নীতিনিষ্ঠ। নেতৃত্ব যখন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তখনই জাতি তার ওপর ভরসা রাখতে শেখে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার একের পর এক সংকটে নিজেদের অস্থিরতা, সিদ্ধান্তহীনতা ও ভঙ্গুর নেতৃত্বের ছবি প্রকাশ করে চলেছে।

জুলাইয়ের অভ্যুত্থান কোনো রুটিন রাজনৈতিক অদলবদল নয়। এটি ছিল দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অসন্তোষ, ক্ষোভ ও বঞ্চনার বিপর্যয়ী বহিঃপ্রকাশ। এক ধরনের ‘নৈতিক জরুরি অবস্থা’ থেকে জনগণ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল; স্বৈরাচারী সরকারকে সরে যেতে বাধ্য করেছিল। জনগণ ভেবেছিল, পরিবর্তনের ঢেউ এবার তাদের ভাগ্যে বাস্তব কিছু বয়ে আনবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুত পরিবর্তন বাস্তবায়নের বদলে এখন যেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব দোটানায় ভুগছে। তারা যেন বুঝেই উঠতে পারছে না, কোন পথে যাবে, কাকে সন্তুষ্ট করবে, কতটুকু আপস করবে, আর কোথায় বলিষ্ঠ অবস্থানে দাঁড়াবে।

সবচেয়ে সম্প্রতিক যে ঘটনাটি এই সরকারকে বিপাকে ফেলেছে, সেটি হলো মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থীদের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু এবং সেই সূত্র ধরে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রাথমিক চেহারা ছিল শোক, ক্ষোভ এবং জবাবদিহিতার দাবি। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সেই চেহারা বদলে যায়। দাবিগুলো আর কেবল তদন্ত কিংবা দোষীদের বিচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে মিডিয়াভিত্তিক একদল লোক সচেতনভাবেই এই ইস্যুকে বড় ধরনের সরকারবিরোধী প্রচারণায় রূপ দিতে সক্ষম হয়।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব ছিল ন্যায্য দাবি ও কৌশলগত উসকানির পার্থক্য শনাক্ত করে দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। সরকারের পক্ষ থেকে শুরুতে একটি সাহসী ও যুক্তিনির্ভর অবস্থান নেওয়া হলেও রাতারাতি সেই অবস্থান থেকে সরে আসা শুধু নীতিগত দুর্বলতাই নয়, বরং তাতে নেতৃত্বের সংকট প্রকাশিত হয়েছে। গভীর রাতে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত বদল, উপদেষ্টাদের অবরুদ্ধ অবস্থায় পড়া এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া- এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশবাসী দেখেছে, সরকার কতটা অপ্রস্তুত ও চাপগ্রস্ত।

এ ঘটনার পর থেকেই প্রশ্ন উঠছে, সরকার ঠিক কী ভাবছে? তাদের মূল রাজনৈতিক অবস্থান কোথায়? সংকটে তারা কাকে শোনে, কার কথা মানে? আর কেন প্রতিটি সংকটে তারা আপসের পথ বেছে নেয়?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের সরকারকাঠামোর দিকে তাকাতে হবে। বিশেষ করে উপদেষ্টা পরিষদ, যারা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। অভ্যুত্থানের পর যারা এই অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণে যুক্ত হয়েছেন, তাদের অনেকেই বাস্তব রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ ছিলেন না। তারা হয়তো প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সক্ষম; কিন্তু রাজপথের বাস্তবতা, জনগণের আবেগ কিংবা বিরোধী পক্ষের কৌশল সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা সীমিত। ফলে সংকট মোকাবিলায় তারা অধিকাংশ সময় আপসকামী প্রস্তাব দেন, যার চূড়ান্ত পরিণতিতে সরকার বারবার আত্মসমর্পণ করে বসে।

এই প্রেক্ষাপটে মাইলস্টোনে বিমান ক্রাশের পর নিছক একটি দুঃখজনক দুর্ঘটনা ঘিরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছিল না, বরং এটি ছিল একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ, যার উদ্দেশ্য ছিল সরকারকে নাজুক অবস্থানে ঠেলে দেওয়া। একজন রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ উপদেষ্টা বুঝতে পারতেন যে এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কী এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করতে হবে। তিনি হয়তো পরামর্শ দিতেন- তদন্ত চলবে, বিচারের ব্যবস্থা হবে, কিন্তু পরীক্ষার মতো একটি মৌলিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করা চলবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এমন সিদ্ধান্ত আর দৃঢ়তা আমরা সরকার থেকে পাইনি।

আজ সরকারের আচরণে যে প্রবণতা স্পষ্ট হচ্ছে তা হলো, ‘চাপ এলেই নতি স্বীকার’। আর এই মনোভাব শুধু সরকারকেই দুর্বল করছে না, বরং আন্দোলনকারীদের আরও সাহসী ও আগ্রাসী করে তুলছে। তারা একের পর এক দাবি তুলছে এবং প্রতিটি দাবি আদায়ের পর নতুন একটি ইস্যু সামনে নিয়ে আসছে। আজ মাইলস্টোন, কাল শিক্ষাসচিব, পরশু হয়তো পুরো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে। সরকারের ভঙ্গুর অবস্থান তাদের প্রতিরোধ নয়, উৎসাহ জোগাচ্ছে।

এই প্রবণতা প্রতিহত করতে হলে সরকারকে একদিকে সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান নিতে হবে, অন্যদিকে প্রয়োজন নতুন নেতৃত্বের উত্থান। নির্বাচনের আগে এমন একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা দরকার, যারা কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক পরামর্শদাতা হবে না, বরং রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে অভিজ্ঞ, কৌশলগত বিচক্ষণ এবং নৈতিকভাবে অটল থাকবে। মাঠের রাজনীতি থেকে উঠে আসা, সংগঠনে দক্ষ, তরুণ ও সৎ নেতৃত্ব ছাড়া এই অস্থির সময়কে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এ ছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী রাজনৈতিক শক্তির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করাই হতে পারে সুন্দর সমাধান।

এবং জনমত ও মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ‘ন্যারেটিভ’-এর বিরুদ্ধে এক প্রকার ন্যারেটিভ যুদ্ধ চালাতে হবে। বর্তমান যুগে মিডিয়া কৌশল হয়ে উঠেছে রাজনীতির অন্যতম শক্তি। জনমনে ‘সরকার ব্যর্থ’- এই ধারণা যদি প্রতিনিয়ত পুষ্ট হয় এবং সরকার তার প্রতিবাদে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও ব্যাখ্যা না দেয়, তবে রাষ্ট্রীয় নৈতিক কর্তৃত্ব হারিয়ে যায়।

সবচেয়ে বড় কথা, সরকারকে এখনই আত্মসমালোচনায় ফিরতে হবে। প্রশ্ন রাখতে হবে নিজেদের কাছে, আমরা কি সত্যিই ‘জুলাই বিপ্লব’-এর চেতনায় আস্থাশীল? নাকি আমরা কেবল ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্রের ইমেজ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকছি? ‘জুলাই বিপ্লব’ যদি কেবল স্মরণীয় দিন হয়, আর তার আদর্শ উপেক্ষিত থাকে, তাহলে তা ইতিহাসে রূপান্তরের চেয়ে ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে থাকবে।

জনগণ এখনও তাদের আস্থা পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয়নি। কিন্তু প্রতিটি আত্মসমর্পণ, প্রতিটি সিদ্ধান্তহীনতা সেই আস্থার সেতুতে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রকে কার্যকর করতে হলে অনেক সময় সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হয়; যা হয়তো অজনপ্রিয়, কিন্তু নীতিগতভাবে সঠিক। সরকার যদি বারবার জনচাপ বা অপপ্রচারে নতি স্বীকার করে, তাহলে নেতৃত্ব ধীরে ধীরে প্রহসনে রূপ নেয়।

প্রয়োজনে সরকারের দায়িত্বশীলদের আরও কোমর শক্ত করে দাঁড়াতে হবে। ‘কোমর শক্ত করে দাঁড়ানো’ মানে কেবল প্রতিপক্ষকে বলপ্রয়োগে দমন নয়, এর মানে নিজের অবস্থানে যুক্তিপূর্ণভাবে দৃঢ় থাকা, জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় অচল না করে চলমান রাখার সামর্থ্য অর্জন করা। অভ্যুত্থান দিয়ে বিজয় এসেছে ঠিক কিন্তু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সে বিজয়ও শূন্যতায় রূপ নেবে হয়তো।

‘জুলাই বিপ্লব’ ছিল এক স্বৈরাচারী অধ্যায়ের বিরুদ্ধে জনরোষের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু আজ প্রশ্ন জাগে, সে চেতনা এখন কার হাতে? কোথায় তার প্রতিফলন? যতদিন সরকার এই প্রশ্নের জবাব না খুঁজবে; ততদিন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকলেও তার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।


সানাউল্লাহ সাগর : কবি ও কথাসাহিত্যিক