সংস্কার ও নির্বাচনের দোলাচলে দেশ

নাহ্‌রীন আই খান
৩০ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সংস্কার ও নির্বাচনের দোলাচলে দেশ

আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা যেন কাটতে চাইছে না। বিশেষ করে সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত সেই সংশয়কে ক্রমশ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু দেশে একটি অর্থপূর্ণ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যে দরকার, সেই অনিবার্যতাও অস্বীকার করছে না কেউই।

দেশের মানুষ সতেরো বছর ধরে ভোট দিতে পারেনি। জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও, সেই অঙ্গীকার পূরণে তিনি প্রথম শর্ত দিয়েছিলেন সংস্কার। এখন সেই সংস্কারে আটকে আছে নির্বাচনের দিনক্ষণ।

বিশেষ করে সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামী সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) নিয়ে বেশ সোচ্চার। এনসিপি চাইছে, অন্তত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চ কক্ষে পিআর কার্যকর করতে হবে। আর জামায়াত যেন আরও এক কাঠি সরেস- তারা নিম্নকক্ষে পিআর চাইছে। তাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন।

অন্যদিকে বিএনপি পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে। এই যে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান, এতে করে যথাসময়ে নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনে সংশয় তৈরি করেছে। গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ পিআর, ইভিএম এসব কিছু বোঝে না। তারা যে পদ্ধতি বোঝে, অর্থাৎ প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোট হতে হবে।

মির্জা ফখরুল খুব একটা ভুল বলেননি, আসলেই তো বাংলাদেশের মানুষ, এত জটিল হিসাবনিকাশ, এত সমীকরণ বোঝে না। তারা চায় তাদের ভোটেই তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হোক। তাদের এমনকি সংসদের উচ্চ কক্ষ কিংবা নিম্ন কক্ষ এসব নিয়েও কোনো মাথাব্যথা নেই।

রিফর্ম এখন এদেশে একটা জনপ্রিয় শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব কিছুতেই এক শ্রেণির মানুষ সংস্কার সংস্কার বলে তার স্বরে কোরাস গাইছে। কিন্তু আমাদের বিদ্যমান বাস্তবতাকে কবুল করেই, সবকিছু করতে হবে, আমরা রাতারাতি তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশকে ইউরোপে পরিণত করার যদি স্বপ্ন দেখি, তবে সেটি হবে ভীষণ রকমের বাড়াবাড়ি। কারণ তাদের দেশের সঙ্গে আমাদের যোজন যোজন ফারাক। সুতরাং আমাদের সব কিছু করতে হবে, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে। না হলে পরে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আমাদের পেয়ে বসতে পারে।

এত এত দোলাচল সত্ত্বেও নির্বাচন নিয়ে দেশে নানামুখী তৎপরতা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলো যে যার মতো প্রস্তুতি নিচ্ছে, সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করছে।

সপ্তাহ খানেক কিংবা দিন দশেক আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতির নির্দেশনা দেন। ওই দিন রাতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রধান উপদেষ্টার বরাতে বলেন, ‘নির্বাচন ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে হবে।’

এখানে একটা প্রশ্ন অবধারিত হবে চলে আসে, তাহলে লন্ডন বৈঠকের ফল কী হলো? এদিকে অনেক দলই নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারকাজ দৃশ্যমান করার যে দাবি জানিয়েছিল, সেটি অনেকটা এখন দৃশ্যমান। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সব সংস্কার ও বিচার সম্পন্ন করার আগে নির্বাচন হতে পারবে না। বিচার একটি দীর্ঘমেয়াদি জুডিশিয়াল কার্যক্রম। অন্যদিকে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। আশার কথা, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনতে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি সোমবার জানিয়েছেন, পাঁচ আগস্টের আগেই ইতোমধ্যে কমিশন বিএনপিসহ সব দলের কাছে ঘোষণার খসড়া পাঠিয়েছে।

আমরা আশা করছি, ডিসেম্বর কিংবা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে হলে, এক্ষুনি দেশবাসীকে নির্বাচনী ট্রেনে উঠানোর প্রস্তুতি নিতে হবে।

পাঁচ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনুস। তার ওই ভাষণে, নির্বাচনের চূড়ান্ত দিনক্ষণ থাকবে বলে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল জানিয়েছে।

আমরা প্রফেসর ইউনূসের প্রতি বিশ্বাস রাখতে চাই। ছাত্রদের দলের প্রতি তার কখনও কখনও সহানুভূতিটা দেখে অনেকে নানা সময় প্রমাদ গোনেন। কিন্তু আবারও বলছি, জনগণ তাকে বিশ্বাস করে বা করতে চায়, তিনি সেই জনগণের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন তো? আমরা আশাবাদী থাকতে চাই।

এদিকে এনসিপি জুলাই সনদ এবং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার ছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছে। জুলাই সনদ স্বাক্ষরে জটিলতা অর্থাৎ নির্বাচন নিয়েও এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়া। মোটা দাগে বেশ কিছু দাবি দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি মেনে নিয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন, বাকি যেসব আছে, সেগুলোর সংস্কারের বিষয়ে নির্বাচিত সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এনসিপি, জামায়াতসহ কয়েকটি দল সব সংস্কার এক্ষুনি চূড়ান্ত করতে চায়। আমরা মনে করি, এমন গো ধরা কোনো পক্ষেরই উচিত হবে না। যেসব সংস্কার না হলে একটি সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে, সেসব সংস্কারের অঙ্গীকারনামা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নিয়ে সংস্কারের বিষয়টিকে গুছিয়ে আনাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে, সেটা হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর আরোপিত কিছুই বেশি দিন টেকে না। তাই ঐকমত্য কমিশনের উচিত অপেক্ষাকৃত নবীন রাজনৈতিক দল এনসিপির তরুণ নেতৃত্বকে সে বিষয়টি বোঝানো। একটা কথা সবার মনে রাখতে হবে, বিলম্বে যেন সব কিছু বিলম্বিত না হয়ে যায়। কারণ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মাথা থেকে ওয়ান ইলেভেনের দুঃসহ স্মৃতি এখনও বিস্মৃত হয়নি। সে সময়ও কিন্তু এই সংস্কার নিয়েই যত আপদ বিপদ মুসিবত এসেছিল। এ বিষয়টিও সবাইকে বিশেষ করে সব রাজনৈতিক দলকে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে।


ড. নাহ্‌রীন আই খান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়