বৃদ্ধাশ্রম নয় যত্ন মিলুক পরিবারে
একটা সময় ছিল যখন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের ঘিরেই আবর্তিত হতো আমাদের জীবনের বড় একটা অংশ। দাদু ঠাকুরমা, নানা-নানিরা ছিলেন পরিবারের অভিভাবক, পরামর্শদাতা এবং ভালোবাসার উৎস। আজ সেই চিত্র পাল্টেছে। শহরের অলিগলিতে গড়ে উঠছে একের পর এক বৃদ্ধাশ্রম। প্রশ্ন উঠছে কেন বাড়ছে এই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা? এর পেছনে দায় কার?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুসারে, দেশে বর্তমানে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের হার প্রায় ৫.৫%। সরকারি বৃদ্ধাশ্রম মাত্র ৬টি, আর বেসরকারি ও দাতব্য মিলিয়ে সংখ্যা ৩০টির বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবীণদের মধ্যে প্রায় ৫৭% পরিবারে অবহেলিত হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে আসতে বাধ্য হয়েছেন। পারিবারিক বন্ধনের ভাঙন, সন্তানদের বিদেশে চলে যাওয়া এবং কর্মজীবী জীবনের ব্যস্ততা এই প্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে।
সমাজে পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন এই বৃদ্ধাশ্রম বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে এখন সবাই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে অভ্যস্ত। পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব এখন অনেকের কাছেই যেন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মজীবন, ব্যস্ততা, বিদেশে বসবাস অথবা নিজের স্বাচ্ছন্দ্য নানা অজুহাতে বাবা-মাকে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে। যারা এক সময় সন্তানদের মুখে আহার তুলে দিয়েছেন, তাদেরই শেষ বয়সে ঠাঁই হচ্ছে একটিমাত্র শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে, যেখানে নেই আত্মার আত্মীয় নেই আপনজনের সঙ্গ। আর্থসামাজিক পরিবর্তনকেও অবহেলা করা যায় না। এখনকার তরুণ প্রজন্মের অনেকেই কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারছেন না। আবার কেউ কেউ বিদেশে চলে গিয়ে বাবা-মাকে একা ফেলে যান। সন্তানদের এই দূরত্ব কখনও শারীরিক, কখনও মানসিক। অথচ বৃদ্ধ মা-বাবার সবচেয়ে বেশি দরকার থাকে সান্নিধ্য ও ভালোবাসার। চিকিৎসা বা আর্থিক সহায়তার থেকেও বড় হয় ভালোবাসা ও নিরাপত্তা।
তবে সব দোষ কি শুধুই সন্তানের? একপেশেভাবে তাদের ওপর দায় চাপানোও ঠিক নয়। অনেক সময় দেখা যায় বৃদ্ধ বাবা-মা নিজেরাও নিজেদের সিদ্ধান্তে বৃদ্ধাশ্রমে যাচ্ছেন যাতে সন্তানদের বোঝা না হতে হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে সংসারে অবহেলার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশ বেশি স্বস্তিদায়ক মনে হয়। সেখানে চিকিৎসা সুবিধা, সহচর্য, যত্ন সবকিছু নিয়মিতভাবে পাওয়া যায়। একাকিত্ব কমাতে অনেকেই এসব স্থানে গিয়ে নতুন বন্ধু তৈরি এবং হবি চর্চা করেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
তবে সমাজের জন্য এই প্রবণতা শুভ নয়। বাবা, মা ও সন্তানের সম্পর্ক শুধুই দায়িত্ব বা বোঝা নয়, এটি আত্মিক বন্ধনের নাম। আমরা যদি ছোটবেলায় তাদের স্নেহ-ভালোবাসায় বেড়ে উঠি তবে বৃদ্ধবেলায় তাদের পাশে থাকা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সরকারি উদ্যোগেও এই সমস্যা সমাধানে কিছু করা দরকার। যেমনÑ পরিবারকে উৎসাহ দেওয়া হোক বৃদ্ধদের দেখাশোনায় সক্রিয় হতে, ছুটির নীতিতে পরিবর্তন আনা হোক যাতে কর্মজীবী সন্তানরা মা-বাবার সঙ্গ পেতে পারেন এবং সামাজিক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো হোক, পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠদের গুরুত্ব নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায়ও পারিবারিক মূল্যবোধ শেখানো উচিত, যেন শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বুঝে নেয় মা-বাবা শুধু পিতামাতা নন, তারাও একদিন সন্তান হয়ে পড়েন, যাদের স্নেহ দরকার, নিরাপত্তা দরকার।
পরিশেষে বলি বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে, কারণ আমাদের ভালোবাসা কমছে। বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হোক নিঃসঙ্গদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে, তবে তা যেন কখনোই না হয় পরিবারের বিকল্প। বৃদ্ধাশ্রম হোক অপশন, অবশ্য করণীয় নয়। যে সমাজ বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান দেয় না, সে সমাজ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। আমাদের চিন্তা করা উচিত, আজ যাদের আমরা বৃদ্ধাশ্রমে রাখছি, কাল আমরাও বৃদ্ধ হবো তাদের মতোই। তখন আমাদের ঠাঁই কোথায় হবে?
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ওম্মে হাবিবা তৃষা : শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।