র্যাবের আয়নাঘরের ভয়ংকর স্মৃতি
ভয়ংকর স্মৃতির এক বছর। ২০২৪ সালের ২৭ জুলাইয়ে যা ঘটেছিল : ১৮ থেকে ২২ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি। অনেকটা সামনের সারিতেই ছিলাম। ভয়ংকর পরিস্থিতি ছিল তখন। আন্দোলন অনেকটা ঝিমিয়ে যায়। কারফিউ শিথিল হচ্ছিল, অফিস আস্তে আস্তে খোলা হচ্ছিল। তখন অনেকটা হতাশ হয়ে ঢাকা থেকে আমার বাসা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে চলে আসি ২৪ জুলাই। বাসাতেই ছিলাম দুই দিন। ২৬ জুলাই শুক্রবার রাতে আমি আর আমার ছোট ভাই ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাৎ দরজায় বাইরে থেকে শব্দ করছে। তখন ঘুম ভাঙলে ফোনটা এক পলক হাতে নিয়ে দেখি রাত ১টা ১৩ মিনিট বাজে। আমার ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমার ছোট ভাইয়ের ঘুম ভাঙে। তখন সে বলেÑ ভাই, দরজা খুলব? তখন বুঝতে পারি যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ এসেছে। কেননা মেইন গেটে তালা দেওয়া আর সেই তালার চাবি আমার কাছে। তখন ছোট ভাই দরজা খুলে বলে, আপনারা কারা, গেটে তালা দেওয়া, কীভাবে ঢুকেছেন? তখন ‘ভেতরে আসামি আছে’ বলেই আমার ছোট ভাইকে ধাক্কা দিয়ে কয়েকজন রুমে প্রবেশ করে। আমি তখনও বিছানায় শুয়ে আছি। একজন আমার হাতে ধরে বলে, ‘তর ফোন কই, নাম কী?’ আমি নাম বলার পর সে আমার বালিশের নিচ থেকে মোবাইল নিয়ে বলে, ‘তর নাম্বার বন্ধ ক্যান?’ তখন রুমের ভেতর ৮-১০ জন, তারা সবাই বিছানার নিচে, সামনে থাকা টেবিলে তন্ন তন্ন করে খুঁজছিল। এই সময়ের ভেতরে পাশের রুমে থাকা মা ও বোন জেগে ওঠে। কয়েকজন আমার মাকে আলাদা নিয়ে যায়। আমি তখন লুঙ্গি পরা, ওরাই একটি প্যান্ট আর শার্ট দেয় আমাকে আর আমার ভাইকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে বলে, আইনের লোক। রুম থেকে বের হওয়ার পর রুমের সামনে এবং বাসার সামনে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ জন লোক, সবাই সাদা পোশাকে। পুরো বাসা ঘেরাও করেছিল। এমনকি বাসার সামনের এবং রুমের সামনের লাইটও তারা খুলে ফেলে। আমাকে এবং আমার ছোট ভাইকে বাসা থেকে নিয়ে যায়। তখন ভয় কাজ করছিল, কারণ আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে গেলে তো বিপদ, কেননা এমন আর কেউ নেই যে খোঁজ করবে আমাদের।
বাসা থেকে মেইন রোড ২/৩ মিনিটের দূরত্ব। মেইন রোডে তাদের মাইক্রোবাস ছিল। মাইক্রোবাসে তোলার সময় একজন বলছিল, ‘আরেকটা কই?’ তখন একজন বলল, ‘আসামি একটাই, ওইটা ছেড়ে দিছি।’ তখন মনে কিছুটা সাহস কাজ করছিল। মাইক্রোবাসে উঠানোর পর যখন পেছনের সিটে যেতে বলে তখন দেখি পেছনের সিটে দুজন র্যাবের ড্রেস পরা, বুঝলাম যে তারা র্যাবের লোক। এরপর আমার চোখ বেঁধে ফেলে। সাদা পোশাকে নিয়ে যাওয়ায় আমার পরিবার ভেবেছিল তারা ডিবির লোক। এরপর কোথায় নিয়ে যায় জানি না। একসময় গাড়ি থামার পর একটি রুমে নিয়ে যায়, সেখানে দেখলেই বোঝা যায় যে এটি টর্চার সেল। সেখানে অনেক সময় আমাকে চোখ, হাত বেঁধে নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা বারবার বলছিল, তাদের প্রশ্নের উত্তর দিলে আমাকে ছেড়ে দেবে। রাত ৩টায় একটি রুমে নিয়ে যায়, সেখানে ছোট একটি লেখা চোখে পড়েÑ ‘র্যাব ১১ আদমজীনগর’, তখন বুঝতে পারি এটা নারায়ণগঞ্জ। তখন একটি ভয় কাজ করছিলÑ যদি ক্রসফায়ার দিয়ে দেয়। ছোট একটি রুমে একা একা আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সেই রুমের অবস্থা অনেকটা কবরের মতো, পরবর্তী সময়ে জানতে পারি সেটাই হলো র্যাবের আয়নাঘর। সেখানে খেতে হয়েছে বাথরুমের পানি। টয়লেট করার ওখানে একটি ট্যাপ ছিল। ২৪ ঘণ্টা র্যাবে রাখার পর তারা শনিবার রাত ১টায় আমাকে নারায়ণগঞ্জ ডিবিতে হস্তান্তর করে। ডিবি সেখানে ২০ ঘণ্টা রেখে রাতে কোর্টে না তুলেই রবিবার রাত ৯টার দিকে কারাগারে পাঠায়।
আটক থাকা অবস্থা র্যাব ও ডিবিকে বারবার বলছিলাম আমার পরিবার কে জানাতে, তার পরও তারা পরিবারকে জানায়নি। নিখোঁজ থাকা দুই দিন আমার বোন আর ভাই নারায়ণগঞ্জ থানায়, ডিবিতে, ঢাকার সিএমএম কোর্ট, ডিবির হেডকোয়ার্টারে ঘুরেছে আমার সন্ধানে। কিন্তু কেউ কোনো সন্ধান দেয়নি। তখন সবচেয়ে টেনশন ছিল পরিবার নিয়ে, কেননা তারা তো জানে না, আমি কোথায় আছি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আবু হানিফ : উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক, গণঅধিকার পরিষদ
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি