জলবায়ু উদ্বাস্তু ও বাস্তবতা
দেশে জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় শহর কক্সবাজারে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ার হার আশঙ্কাজনক। কক্সবাজারের টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়াসহ এসব এলাকার আশপাশের ছোট ছোট দ্বীপে সাগরে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, অব্যাহত ভাঙন, প্যারাবন উজাড়, পরিবেশগত বিপর্যয়, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বসতভিটা হারিয়ে অনেক মানুষ গৃহহীন। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে এবং পড়বে। এর কারণ, অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে লাগোয়া এবং এই উপকূলের স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশির ভাগই দরিদ্র। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলের আর্থিক ক্ষতি ও জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়া- এ দুই বিপদই বেশি। এখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ মৎস্যসম্পদের ওপর তাদের জীবিকার জন্য অনেকাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এই প্রাকৃতিক সম্পদভাণ্ডারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে উদ্বাস্তু হয়ে ভিটেমাটি হারানো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে।
পত্রিকার ভাষ্য মতে, উপকূলীয় এসব এলাকায় বসতভিটা হারিয়ে পাহাড়ি এলাকা এবং বড় শহরগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছেন মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এসব উপজেলায় মানুষের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। লোনাপানির আগ্রাসনে ফলছে না ফসল, পাওয়া যাচ্ছে না সুপেয় পানি। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে জমি বিলীন হচ্ছে সাগরে। পেশা পরিবর্তনের ফলে অনেকেই পড়েছেন বিপাকে। যে কোনো অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে নারী ও শিশুদের। বাস্তুচ্যুতি ঘটলে তাদের এ সংকট আরও গভীর হয়। যারা উদ্বাস্তু হয় না, তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগতে হয়। বিভিন্ন তথ্য মতে, ১৮৭২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত পাঁচটি বড় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফসহ এসব এলাকার ছোট ছোট দ্বীপে মানুষের ঘরবাড়িসহ আবাদি অনেক জমি সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে এসব উপজেলার লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে এলাকা ছেড়েছে। এখনই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ না নিলে সংকট আরও বাড়বে। শুধু বঙ্গোপসাগর উপকূলবাসীই নয়, উষ্ণায়নের কবলে আসলে আমরা সবাই।
প্যারাবন ধ্বংসের কারণে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়ার বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও দুর্নীতির কারণে টেকসই বাঁধ হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁঁকি মোকাবিলায় মহেশখালী, কুতুবদিয়া টেকনাফে সুপার ডাইক নির্মাণ অতি জরুরি। যদিও অনেকদিন ধরেই সুপার ডাইক নির্মাণের কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সেই কাজ এখনও আশার আলো দেখেনি। সুপার ডাইক টেকসইভাবে নির্মাণ করা গেলে যেমন ভাঙন হ্রাস পাবে, তেমনি ভূমিহীন হওয়ার আশঙ্কাও কমে যাবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা টানা চার বছর ধরে বাড়ছে। গত মে মাসে নরওয়েভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) প্রকাশিত বৈশ্বিক অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি প্রতিবেদন-২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। দুর্যোগে বাস্তুচ্যুতির বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। মূলত বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এসব বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। একজন মানুষ যখন তার বসতভিটা হারিয়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নেয়, তখন তার মানসিক অভিঘাত হয় গভীর। এর বাইরে তাদের প্রথম সংকট হয় আবাসনসংকট। এরপর থাকে বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুতের সংকট। এগুলো অবৈধভাবে ব্যবস্থা করে নিতে হয় তাদের। এ জন্য বাস্তুচ্যুতদের মৌলিক পরিষেবা, সামাজিক সুরক্ষা ও জীবিকার বিকল্পগুলোয় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
জলবায়ু উদ্বাস্তু হওয়ার পেছনে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার সঙ্গে সভ্যতার অবস্থার একটা সরাসরি যোগ আছে। আবহাওয়া বিষয়টি যত বাঁধাধরা হিসাবের মধ্যে এসেছে, মানবজাতি ততই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে পেরেছে। তারা মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে কৃষিব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, নির্ভরতা দিতে পেরেছে বৃহৎসংখ্যক গোষ্ঠীকে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া ব্যাপারটা অনেকের কাছেই একটু দুর্বোধ্য বটে, খুব তাড়াতাড়ি তার ফলাফলও দেখা যায় না। এসব ঘটনা কেবল শিক্ষিত ও পরিবেশসচেতন মানুষকেই উদ্বেল করে। সাধারণ জনগণ এগুলো নিয়ে তখনই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে, যখন তার নিজের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
বস্তুত জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অসাম্য, ধনীদের অতিরিক্ত লোভের আকাক্সক্ষা, ভোগ-বিলাসিতা, জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার এবং অন্যায্যতারই ফল। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে না পারায় এর নেতিবাচক প্রভাব দরিদ্র ও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক অসাম্য ও বঞ্চনা আরও তীব্রতর করছে, সেই সঙ্গে সৃষ্টি করছে বিপুল জলবায়ু উদ্বাস্তু। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ধনী ও উন্নত দেশগুলোর দায়দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ধনী দেশগুলো এখনও যথেষ্ট আন্তরিক ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রকৃতি ও মানুষের ওপর তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নানা প্রভাব নিয়ে আলোচনা ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিবছরই প্রায় ২০০টি দেশ মিলিত হয়
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
কখনও প্যারিসে, কখনও বাকুতে, দুবাইয়ে, কখনও কোপেনহেগেনে। সম্মেলনের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হলেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, এই বর্ণাঢ্য সম্মেলনগুলো আমাদের আশা জিইয়ে রাখে। না হলে আমরা পানিতে ভেসে যাওয়ার আগেই হতাশায় ডুবে যেতাম। কিন্তু প্রতিবছরের এই আয়োজন কতটা সমস্যার মূলে আঘাত করতে পারছে বা আদৌ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে পারছে কিনা তা একটা বড় প্রশ্ন বটে। সেই সঙ্গে নানা কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে সব রাষ্ট্র সমানভাবে সহায়তাও করছে না।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু উদ্বাস্তু আমাদের দারিদ্র্য নিরসন প্রক্রিয়া এবং সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা না গেলে আমাদের জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে, তাতে ভবিষ্যৎ যে কোনো উন্নয়ন উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে গতিশীল রাখতে অবশ্যই আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে হবে। সে জন্য বিশ্বসম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের একযোগে কাজ করে ধনী দেশগুলোর ওপর নৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের বর্তমান ও নিকট ভবিষ্যতের দায়িত্ব হবে- প্রথমত, বিশ্বে আমাদের বিপন্নতা ও নৈতিক অধিকার তুলে ধরার জন্য জোরালো প্রচারণা, দ্বিতীয়ত, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পরিকল্পিতভাবে অভিবাসনের ব্যবস্থা করা। আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন রোধের কর্মকাণ্ডকে সংযুক্ত করতে হবে। আর অবশ্যই উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধের মূলে থাকতে হবে দারিদ্র্য বিমোচন। এখনই সর্বাত্মক চেষ্টা না করলে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত উদ্বাস্তু পরিস্থিতি যথেষ্ট ভীতিপ্রদ হতে পারে। সেই সঙ্গে উষ্ণতর পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার নানা কৌশল ও উপায়ও কার্যকর করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা শেষ বিচারে আমাদের সবারই সমস্যা। আর সামগ্রিকভাবে একজনও যদি সুরক্ষিত না থাকে তাহলে আসলে আমরা কেউই সুরক্ষিত নই।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
সফিক চৌধুরী : বিতার্কিক ও কলাম লেখক