শুভ মৃত্যুদিন

রাসেল রায়হান
২৫ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
শুভ মৃত্যুদিন

পকেট ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। সাউন্ড খুবই কম, কল এলে টের পাওয়া যায় না। ফোনটা আর না পাল্টালেই নয়! নতুন একটা স্মার্টফোন কিনবে, সে সাধ্য অবশ্য নীলের নেই।

নীল একজন মূকাভিনেতা। রাস্তায় রাস্তায় শো করে বেড়ায়। লোকজন খুশি হয়ে যা দেয়, তা দিয়েই সংসারের পাঁচটি পেটের ক্ষুধা মেটে। পাঁচজন মানে নীল, মুনিয়া ও নীলের মা-বাবা (বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তারা নীলের সঙ্গে থাকে)। আর সৌরিন- নীলের পালিত মেয়ে- আড়াই বছর আগে তাকে কেউ এক ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। কুকুরের দল বস্তার ভেতর থেকে বের করে ঠোঁট ও নাকের বেশ খানিকটা অংশ খেয়ে ফেলে। ভাগ্যক্রমে নীলের চোখ পড়েছিল সেদিকে।

আলাদা করে কোনো গল্প-স্ক্রিপ্ট ভাবে না নীল। নিজের গল্পগুলোই সে নানা অঙ্গভঙ্গি করে দেখায়- ‘এরপর কী হলো, জানেন? পুলিশ আমাকে এমন মারটা দিল, আমি ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে দৌড়াতে লাগলাম।...ঠিক এভাবে...’ বলে একটু নুয়ে আলতো করে একটা হাত রাখে ডান পায়ে। তার পর বাঁ হাতের ছড়িটা শূন্যে তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে টেনে টেনে কিছুদূর দৌড়ে যায় নীল। সামনের প্রতিটা মানুষ হো হো করে হেসে ওঠে। কেউ কেউ পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ে। নীল খেয়াল করেছে, যা তার নিজের কাছে করুণ গল্প, মানুষ তাতে বেশ মজা পায়। নদীর ঢেউকেও বোধহয় তীরের কাছে এমন নির্মম অট্টহাসি মনে হয়, যার ধাক্কায় তীরও প্রতিনিয়ত ভেঙে ভেঙে যায়। একের পর এক রিংটোন বেজেই যাচ্ছে। চারপাশে সেøাগানও বেড়ে চলছে- ‘একটা মাত্র দাবি/ স্বৈরাচার যাবি।’

নিশ্চয়ই মুনিয়া- নীলের স্ত্রী। অন্য কেউ হলে একটা-দুইটা কল দিয়ে থেমে যেত। এখন ফোন ধরলে মুনিয়া কথা তো কিছু বুঝবেই না, বরং বুঝে যাবে যে সে আন্দোলনে এসেছে। কল কেটে দিয়ে মেসেজ দিল নীল। লিখল, ‘যা বলার, মেসেজে বলো।’

পনেরো দিন ধরে রোজ আন্দোলনে আসে নীল। মুনিয়াকে সে বলেনি কখনও। নীল চায় না, এসব জটিলতা মুনিয়াকে স্পর্শ করুক। মুনিয়ার জন্য প্রয়োজন একটি সুন্দর শহর, যেখানে সবাই শুধু আনন্দই করবে। এই স্বৈরাচারকে না তাড়াতে পারলে সৌন্দর্য ফিরে পাওয়া যাবে না।

আশ্চর্য একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে এই কদিনে নীলের মধ্যে। ইনজেকশন লাগানো দেখলে যে নীলের শরীর কাঁপত ভয়ে, নিজের হাতে সে অপরিচিত সঙ্গীর পা থেকে টেনে বুলেট বের করেছে। ভয়াবহ সব ক্ষত বেঁধে দিয়েছে...

মেসেজ পাঠানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মুনিয়ার জবাব এলো- ‘কতদূর তুমি? তাড়াতাড়ি আসো। আব্বুকে বসিয়ে রেখেছি। কেক আনতে ভুলো না।’

এটা পড়তে পড়তেই আরেকটা মেসেজ- ‘বারোটা বাজতে দশ মিনিট আগে হলেও বাসায় ঢুকবে। আমি সব রেডি করে রাখব। আব্বুকে সারপ্রাইজ দেব।’

নীলের মনে পড়ে যায়, মুনিয়া তাকে কেক নিয়ে যেতে বলেছে।

দুই. একমাত্র বোনের বিয়ের পর মা-বাবা এসে এখানে ওঠায় নীল কিছুটা বিরক্তই হয়েছিল। কিন্তু মুনিয়ার ভেতরে ছিল অকৃত্রিম আনন্দ। সেটা দেখে সব বিরক্তি কেটে যায় নীলের।

মহাধুমধামে সৌরিনের জন্মদিন পালনের সপ্তাহখানেক পর ঘুমানোর ঠিক আগে আগে মুনিয়া বলেছিল, ‘কাল একটা কেক নিয়ে আসবে। কেকে লিখবে, ‘হ্যাপি বার্থডে মা।’

নীল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী! কাল মায়ের জন্মদিন নাকি? কে বলল?’

মুনিয়া চোখ পাকিয়ে বলে, ‘মায়ের এসএসসির সার্টিফিকেট দেখে আমি বের করেছি।’

নীল বলে, ‘আরে, ওসব ভুয়া।’

মুনিয়া আরও চোখ পাকায়, ‘হোক ভুয়া।...তুমি অবশ্যই কাল কেক আনবে।’

‘আচ্ছা।’

মা অবশ্য খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। সম্ভবত এই নশ্বর জীবনে এর চেয়ে বেশি আনন্দ তিনি আগে কখনও পাননি।

মুনিয়া বোধহয় এবার আব্বুর জন্মদিনও বের করে ফেলেছে কোনোভাবে।

আজ বোধহয় বাসায় ফিরতে দেরি হবে। যত দেরিই হোক, সাড়ে এগারোটার মধ্যে বাসায় ফিরতেই হবে। সবাই মিলে আব্বুর জন্মদিন পালন করবে। সেøাগানের মধ্যেই ফোন বের করে এলাকার পরিচিত লোকটিকে কেকের অর্ডার দেয় সে। মেসেজে বলে দেয়, কেক যেন অবশ্যই রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

নীল ঠিক করেছে, আজ দশটা পর্যন্ত থাকবে এই এলাকায়। তার পরই বাসার দিকে রওনা দেবে। হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরতে হবে। কদিন ধরে কারফিউ চলছে। গাড়ি-টাড়ি কিছুই পাওয়া যায় না। এমনিতে অবশ্য মিনিবাসে করে ঝুলতে ঝুলতে বাসায় ফিরতে হয় নীলকে। কখনও ভাগ্যক্রমে সিট পেলে গুটিসুটি মেরে বসে। পাশেই বসে থাকে অন্য কেউ, তার দিকে ফিরেও তাকায় না নীল। পাশের লোকটিও নিশ্চয়ই নীলের দিকে তাকায় না। অনেকদিন হলো, এই শহরে কেউ হাসে না, অন্তত অপরিচিতের দিকে তাকিয়ে। সবাই ক্রমাগত হাসতে ভুলে যাচ্ছে। নীলের মনে হতো, এভাবে চললে কোনো একদিন হয়তো কারও মুখের পেশিই আর বাঁকবে না। বিবর্তনবাদ তো তা-ই বলে!

কদিন আগেও, এই তো আন্দোলন শুরুর আগেই তার আফসোস হতো, একদিন সম্ভবত এমন সময় একদম বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যেখানে কেউ একজন আরেক অপরিচিতজনের দিকে তাকিয়ে হাসে। তাকিয়ে থাকে...

সেøাগান দিতে দিতে পায়ের নিচে একটি চশমা পড়ে নীলের। পায়ের চাপে ভেঙে গেছে। মোটা কাচ বেরিয়ে গেছে ফ্রেম থেকে। কার চশমা কে জানে! সে নিশ্চয়ই সবকিছু অস্পষ্ট দেখছে এখন। এই রুক্ষ শহরে থাকতে থাকতে কদিন আগে পর্যন্তও নীলের মনে হতো, এই শহরে কোনো স্পষ্ট মানুষ নেই। সবাই কেমন ঝাপসা ঝাপসা!

এখন অবশ্য এসব ভাবে না নীল। সে জানে যে মানুষ আসলে সব সময়ই অস্পষ্ট, যতক্ষণ না তারা সবাই একই বিপদে পড়ে। সবার বিপদ এক হলে সবার চেহারা কেমন এক রকম হয়ে যায়। তখন সবাইকে নিজের মতোই স্পষ্ট ও নগ্ন মনে হয়। যেন সামান্যও আড়াল নেই।

এই যে ছেলেগুলো একের পর এক মারা যাচ্ছে, নিজের জন্য তো নয়। অন্যরা ভালো থাকবে, মন খুলে কথা বলতে পারবে, আনন্দে বেঁচে থাকতে পারবে- এটা ভেবে গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াচ্ছে একেকজন। আনন্দে মারা যাচ্ছে। দুঃখের বিষয় হলো, এরা কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না, অন্যরা সত্যি সত্যি আনন্দে বেঁচে থাকবে কি-না। এমন অনিশ্চয়তা নিয়েও জীবন বিলিয়ে দিতে পারে একমাত্র মানুষই।

নীল নিজেই তো প্রতিদিন আন্দোলনে আসে বাসায় ফিরতে পারবে না ভেবে। আজ অবশ্য বাসায় ফিরতে হবে। আব্বুর জন্মদিন। সবাই একসঙ্গে কেক কাটবে।

তিন . পরিস্থিতি বুঝে দুজন দুজন করে গেরিলা যোদ্ধার ঢঙে বুকে হেঁটে হেঁটে সামনে এগোচ্ছে ছেলেগুলো। আড়াল হিসেবে সামনে লোহা বা প্লাস্টিকের ব্যারিকেড। ব্যারিকেডের আড়াল গুলি ঠেকাতে পারে না, তবে যে লাভ হয়, সামনে আড়াল থাকলে প্রতিপক্ষ টার্গেট করতে পারে না সহজে। ওরা গেলে পেছনের দল এগোতে থাকে। একটা বড় অংশ এক জায়গায় পৌঁছাতে পারলে একসঙ্গে ধাওয়া দেয় প্রতিপক্ষকে। প্রতিপক্ষ বলতে অস্ত্র হাতে সরকারি ছাত্র সংগঠনের লোকজন আর পুলিশ, বিজিবি।

ওপাশ থেকে টিয়ারশেল আসে, সাউন্ড গ্রেনেড আসে, রাবার বুলেট আসে। আর আসে সত্যিকারের গুলি।

এ রকম একটা গুলি এসে আচমকা ধাক্কা মারে নীলের বুকে। সে ছিটকে পড়ে রাস্তায়।

চারপাশ আবার অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোথাও কি বৃষ্টি হচ্ছে? পানি জমেছে চশমার কাচে? ফোনটাও বাজছে বোধহয় আবার। কেমন কাঁপছে পকেটের কাছটা।

পুরো বাড়ি আজ সাজিয়েছে মুনিয়া। আজ নীলের বাবার জন্মদিন। বাবা খুশি হলেই নীলও খুশি হবে। নীলকে খুশি করার জন্যই তো মুনিয়ার যত পাগলামি। সে জানে, নীল তার এই পাগলামিগুলোকে কত ভালোবাসে!

ঠিক সাড়ে এগারোটায় দরজায় নক হলো। মুনিয়া দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। নীল এলো নাকি?...নাহ! ডেলিভারি বয় কেক নিয়ে এসেছে। এরা চব্বিশ ঘণ্টা অর্ডার নেয়। নতুন শুরু করেছে, কিন্তু সেবা খুব ভালো।

কেকটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় মুনিয়া। বাবা বাসি পেপার পড়ছেন ওই রুমে বসে। তাকে দেখানো যাবে না। তাড়াতাড়ি করে শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে রান্নাঘরে কেকটা রেখে আসে সে। আবার দরজায় ধাক্কা।

এবার নিশ্চয়ই নীল। কেকটা রেখেই দরজার দিকে দৌড় দেয় মুনিয়া। া