চিন্তার প্রেরণাবাদী ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান
বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পের ইতিহাসে চিরন্তন প্রেরণাবাদী হয়ে বেঁচে থাকবেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। তিনি এমন একজন ভাস্কর, যিনি রূপকে খুব সাবলীলভাবে কাঠামোগত অবস্থানে নিয়ে চিন্তার মাত্রাকে প্রকাশ করেছেন। চিন্তার আলেখ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে রূপ ও মাধ্যমের বিবেচনাবোধ দ্বারা দৃশ্যশিল্পের জগৎ সমৃদ্ধ করেছেন, যেখানে মন ও মননে জাগরণের হাতিয়ার হিসেবে বুদ্ধির খোরাকি হয়ে সুন্দরের প্রতিরূপ নির্মিত হয়। আবার রূপের আবহকে মাধ্যমগত সৌন্দর্য দ্বারা নির্মাণ করেছেন, যা সত্যিই কষ্টসাধ্য। কিন্তু তিনি পেরেছেন, সফলও হয়েছেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। গত ২০ জুলাই পাড়ি জমিয়েছে দূর নক্ষত্রলোকে। ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের প্রতি রইল অসীম শ্রদ্ধা।
শিল্পী হন নিভৃত রূপসন্ধানী। হামিদুজ্জামান আকারের প্রচলিত ধারণা খারিজ না করে দিয়েও প্রতিমুহূর্তে সন্ধান করে বেড়িয়েছেন সিন্থেটিক রূপ কীভাবে নির্মাণ করা যায়। ভাস্করের কাজে কখনোই মাধ্যম থেকে বিষয় এবং বিষয় থেকে আবেগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। নিরেট ছন্দ তৈরিতে দক্ষ এবং সত্যিকারের সৌন্দর্যবিদ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তিনি। জ্যামিতিক ফর্মের মধ্যে প্রকৃতি ও মানবজীবনের ধরন এবং আঙ্গিকনির্ভর চেতনা তুলে ধরার ক্ষেত্রে তার কাজ অতুলনীয়।
ভাস্কর্য নির্মাণে একাডেমিক চিন্তার বাইরে ভিন্ন ভিন্ন নতুন মাধ্যম সম্পর্কিত ধারণাকে তিনি পরিচয় করিয়েছেন এবং নিজে কাজ করেছেন। তিনি বিষয়ভিত্তিক ভাব ও আবেগকে তার নির্মাণকলার মাধ্যমে প্রমাণসাপেক্ষ করে তুলেছেন। তিনি বিন্যাসের নানা পর্যায়ে নিজের ভাবনাকে সুবিন্যস্ত করেছেন, মাধ্যমভিত্তিক বিস্তর নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে জীবনসংক্রান্ত অনুষঙ্গ এবং বস্তুভিত্তিক সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। মূর্ত নয়, এমন অনেক আকারিক অবয়ব তৈরি ও বিন্যাসের মধ্যে এক ধরনের ছন্দময় দ্যোতনা তিনি সৃষ্টি করতে পারতেন; তিনি সাজিয়েছেন চিন্তা, আলোকিত করেছেন জীবনকে এবং ছন্দময় করে তুলেছেন মানুষের ভাবনাগুলোকে।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে হামিদুজ্জামান ঢাকা আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। বাংলাদেশের আরেকজন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী এবং ভাস্কর ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, যিনি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম ভাস্কর্য করেছিলেন। ভাস্কর্যটির নাম ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’। এটি নির্মাণকালে শিল্পী আব্দুর রাজ্জাকের সহযোগী ছিলেন হামিদুজ্জামান খান। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান ১৯৭১ স্মরণে নির্মাণ করা একটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য ‘দরজা’র জন্য শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার ‘পাখি পরিবার’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ‘জাগ্রত বাংলা’ ভাস্কর্যগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘জাগ্রত বাংলা’ ভাস্কর্যটি আশুগঞ্জ জিয়া সার কারখানায় স্থাপন করা হয়। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ কোরিয়া সিউল অলিম্পিক পার্কে তিনি ‘স্টেপস’ (সিঁড়ি) নির্মাণ করেন।
আমার কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ তার কাজটি হচ্ছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করা ‘সংশপ্তক’ ভাস্কর্যটি। এটি নির্মিত হয় ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। এ কাজের মধ্য দিয়ে তিনি বিষয় এবং আকারিক বিন্যাসকে প্রমাণসাপেক্ষ করে তুলতে পেরেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে ভাস্কর্য তৈরি করেছেন, ঢাকা সেনানিবাসের ‘বিজয় কথন’, ঘাটাইল সেনানিবাসের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য এবং ময়মনসিংহ সেনানিবাসের ‘বিজয়গাথা’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ইতিহাস ও প্রজন্মভিত্তিক চিন্তার উপলক্ষ হয়ে টিকে থাকবে।
আরও পড়ুন:
শুভ মৃত্যুদিন
পাখি পছন্দ করতেন তিনি। পছন্দ করতেন মাছ, গাছ, লতাপাতা ইত্যাদি। ফলে প্রকৃতিজীব্য নানা মোটিফ আমরা তার কাজে দেখতে পাই। নগর সৌন্দর্য চিন্তার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক তৈরির একজন অনন্য কারিগর ভাস্কর হামিদুজ্জামান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ‘শান্তির পায়রা’ নামে এবং ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে ‘পাখি’ শিরোনামে ভাস্কর্য তৈরি করেন বারিধারায়। এটা এক অদ্ভুত অনুভূতি। তিনি মনস্তাত্ত্বিকভাবে সবসময় মুক্ত থাকার চেষ্টা করতেন। সহজ-সরল প্রাণের মানুষ ছিলেন তিনি। ছিল মুক্তভাবে চিন্তা করার সক্ষমতা, যা সৃষ্টিচিন্তাকে বৈচিত্র্যময় করেছে। তিনি বাংলাদেশের নগর ভাস্কর্যকে অনন্য মাত্রায় উত্তীর্ণ করেছেন। আমি মনে করি, নগর স্থাপনার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক তৈরিতে তার দারুণ ভূমিকা রয়েছে; তিনি মিনিমাল শিল্পচর্চার মধ্য দিয়ে নগরের সঙ্গে স্থাপনার সৌন্দর্যকে মিলিয়ে দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন এবং সার্থক হয়েছেন। ভাস্কর্যে অবদানের জন্য ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি একুশে পদক পান। া
আরও পড়ুন:
পুনর্জন্মের আগে