আহমদ ছফা মানবিকতায় ও দূরদর্শিতায়

ড. সুদীপ্ত হাননান
২৫ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আহমদ ছফা মানবিকতায় ও দূরদর্শিতায়

গতানুগতিকভাবে বলা হয়ে থাকে, আহমদ ছফা প্রচণ্ড রাগী এবং বিক্ষুব্ধ স্বভাবের মানুষ। কিন্তু তার সামগ্রিক জীবনে আমরা দেখতে পাই, তিনি বাংলাদেশের অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি মানবিক এবং তার সাহিত্যের যে বক্তব্য, তা অনেক বেশি দূরদর্শী। আহমদ ছফা ৮টি উপন্যাস, ১৬টি প্রবন্ধের বই, ২টি গল্পের বই, ৫টি কবিতার বই, ৩টি অনূদিত বইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের পাঠককে নানাভাবে প্রণোদিত করেন। বাংলাদেশ একটি যথাযথ স্বাধীন ও অনুসরণীয় দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক- এটি ছিল তার মূল লক্ষ্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তরুণ কবি আবুল হাসানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য পুনঃভর্তি হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু আবুল হাসানের হাতে তখন কোনো টাকা ছিল না। আহমদ ছফা বিষয়টি জানতে পারেন। তখন আহমদ ছফা নিজের বই প্রকাশের ‘রয়্যালিটি’ আবুল হাসানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন পুনঃভর্তি হতে। স্বাধীনতার পর কোনো কারণে কবি ফররুখ আহমেদের সরকারি অর্থ বন্ধ হয়ে যায়। আহমদ ছফা বিষয়টি জানতে পেরে খুব ক্ষেপে যান। তিনি এ নিয়ে হইচই শুরু করলে সরকারের তরফ থেকে ফররুখ আহমেদকে টাকা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় হুমায়ূন আহমেদের পিতা শহীদ হন। সেই কারণে সরকার এই অসহায় পরিবারকে থাকার জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর হুমায়ূন আহমেদদের সেই বাড়ি সরকার নিয়ে নেয়। এ ঘটনা শুনে আহমদ ছফা হুমায়ূন আহমেদদের পাশে এসে দাঁড়ান। হুমায়ূন আহমেদদের বাড়ি সরকার নিয়ে নেওয়ার প্রতিবাদে আহমদ ছফা নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এ রকম নানা বিপদাপন্ন মানুষের পাশে আহমদ ছফা নিজের সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াতেন।

আহমদ ছফা অনেককেই নানাভাবে উপকার করেছেন। তাদের অনেকেই পরবর্তী সময় নিজের অবস্থানে বিখ্যাত হয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের যাবতীয় ব্যবস্থা করেন আহমদ ছফা। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে কথাসাহিত্য শাখায় আহমদ ছফা ‘লেখক শিবিরের’ সভাপতি হিসেবে নিজ স্বাক্ষরে হুমায়ূন আহমেদকে পুরস্কার দিয়েছিলেন। প্রথম বই প্রকাশ এবং কথাসাহিত্য শাখায় পুরস্কৃত করে আহমদ ছফা সেই ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দেই হুমায়ূন আহমেদের চলার পথের ভিত্তি অনেক মজবুত করে দিয়েছিলেন।

আহমদ ছফা মোরশেদ শফিউল হাসানকে ‘গণকণ্ঠের’ চাকরিতে সংশ্লিষ্ট করিয়ে তার বেকারত্ব দূর করান। শিহাব সরকার যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে বেশ অর্থ সংকটে পড়েন, তখন আহমদ ছফা ‘দাবানল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করছিলেন। তিনি শিহাব সরকারকে ‘দাবানল’ পত্রিকায় চাকরি দেন। শুধু তা-ই নয়, আহমদ ছফা বুঝতে পেরেছিলেন, শিহাব সরকারের কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই। তাই তিনি ইন্টারভিউয়ের দিনই বেতনের টাকাটা দিয়ে দিতে বলেছিলেন। শিহাব সরকারের আর্থিক সংকট যেমন ‘দাবানল’ পত্রিকায় চাকরির সুবাদে দূর হয়েছিল, তেমনি সাংবাদিকতার হাতেখড়িও হয়েছিল। অসীম সাহা এমএ প্রথম পর্ব পরীক্ষার ফরমফিলাপের আগে অর্থ সংকটে ছিলেন। বিষয়টি অসীম সাহা আহমদ ছফাকে জানান। আহমদ ছফা অসীম সাহাকে দিয়ে ডিরোজিও’র ওপর একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করান এবং সেটি ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’ নামক প্রকাশনী সংস্থায় জমা দিয়ে তা প্রকাশের শর্তে দুইশ টাকা অগ্রিম এনে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক সাঈদ-উর রহমানের প্রথম বইও প্রকাশের যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন আহমদ ছফা। সাঈদ-উর রহমানের চারু মজুমদার ও অন্যান্য প্রসঙ্গ বইটি আহমদ ছফা বাংলাবাজারের ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে একটি নতুন প্রেস থেকে প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। সাঈদ-উর রহমান নিজের সেই বইটি প্রকাশের কারণে আহমদ ছফার কাছে প্রুফ দেখাও শিখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মনসুর মুসার প্রথম সংকলিত গ্রন্থ বাংলা ভাষা প্রকাশের ব্যবস্থাও আহমদ ছফা করেছিলেন। মনসুর মুসা কেবল প্রবন্ধগুলো নির্বাচন করেছিলেন এবং সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। আহমদ ছফা বাকি সব কাজ নিজে করে মনসুর মুসাকে প্রকাশনা জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

আহমদ ছফা এভাবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। কারও অর্থ সংকটেও নিজের সাধ্যমতো সহজাতভাবে সহায়তার হাত প্রসারিত করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. নাজমা শাহীনের বিয়ের সময় তার পিতার যেখান থেকে টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তা আটকে যায়। নাজমা শাহীনের বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচের জন্য যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য আহমদ ছফা নিজের সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি বাংলাবাজারে কোনো এক প্রকাশকের কাছে বিক্রি করে দিয়ে টাকাটা নাজমা শাহীনের পিতার হাতে ধার হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন।

এভাবেই আহমদ ছফা অনেকের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়েছেন, বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সহায়তার মানসিকতায় এগিয়ে এসেছেন। হুমায়ূন আহমেদ, মোরশেদ শফিউল হাসান, অসীম সাহা, শিহাব সরকার, অধ্যাপক সাঈদ-উর রহমান, ড. নাজমা শাহীন, অধ্যাপক মনসুর মুসাসহ নানাজনকে আহমদ ছফা হাত ধরে ওপরে এনেছেন। আহমদ ছফা মারা যাওয়ার পর প্রত্যেকে লিখিতভাবে তা প্রকাশও করেছেন। তারা প্রত্যেকে নিজের অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আহমদ ছফা জীবিতাবস্থায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন- এটা কি কেউ মানেন! অথবা আহমদ ছফাকে কি কেউ পরম মমতায় তেমনভাবে বুকে নিয়েছেন? জীবিতাবস্থায় আহমদ ছফার চারপাশের বিশিষ্টজনদের কাছে যেমনই থাকুন, তিনি মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশের পাঠক পরম আগ্রহে ও মমতায় আহমদ ছফার লেখা ও চিন্তাকে বুকে ধারণ করছেন।

ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করে ২৩ বছর পর আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। আহমদ ছফা মারা গেলেন ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই। ঠিক ২৩ বছর পর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের হাজার হাজার, লাখ লাখ যোদ্ধা আহমদ ছফার বিদ্রোহী চিন্তা-চেতনায় শানিত হয়ে দেশকে বৈষম্যমুক্ত করতে প্রাণবাজি রেখে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে দাঁড়াবেই অথবা মানুষ জড় পদার্থ বা গাছপালা, পশুপাখি নয়, মানুষকে মানুষের সমাজে বসবাস করেই সার্বিক ন্যায়ভিত্তিক ও সমতার জীবন প্রতিষ্ঠা করতে হবে- আহমদ ছফার এই বোধকে বুকে ধারণ করেন বাংলাদেশের নানা অবস্থানের লেখক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিককর্মী, সংবাদকর্মী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী। া