প্রত্যাখ্যানের সম্মতি
পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ে বাঙালির ধারণা ছিল রাষ্ট্র হবে দুটি- একটি পূর্ব পাকিস্তান, অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান; ছবিটা ওইভাবেই তুলে ধরা হয়েছিল প্রথমে, মানচিত্রে ও বর্ণনায়। পরে দেখা গেল, দুটি নয়- একটি পাকিস্তান হচ্ছে। কেবল তাই নয়, রাজধানী হচ্ছে করাচিতে, সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স রাওয়ালপিন্ডিতে, গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তানি কোটা থেকে অবাঙালিরাও আসন পাচ্ছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বাঙালি সদস্য মাত্র দুজন, একজন অবাঙালিদের তল্পিবাহক, অপরজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, অর্থাৎ উভয়ের অবস্থানই দুর্বল। টের পাওয়া গেল রাষ্ট্র চালাচ্ছে আমলারা এবং উঁচুতলার আমলাদের মধ্যে বাঙালি একজনও নেই। সেনাবাহিনীতেও বাঙালির অবস্থান অথৈবচ। উর্দুর ঘোষণা ছিল খুবই স্পষ্ট আঘাত এবং অত্যন্ত নিষ্ঠুর। সেই আঘাতে সচেতন হয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল বাঙালি। শাসকরা বলত এটা বামপন্থিদের কাজ। নিতান্ত মিথ্যা বলেনি, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কাজ বামপন্থিরাই করে। ওটি দক্ষিণপন্থিদের সাজে না। সেই অর্থে পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষই তখন বামপন্থি। বায়ান্ন সালে নূরুল আমীন ছিলেন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী; ব্যবস্থাপক পরিষদে দাঁড়িয়ে তিনিও বামপন্থিদেরই অভিযুক্ত করেছিলেন। অনেক পরে, ১৯৭০-এ তিনি যে কথা এতদিন বলিনি নামে একটি পুস্তিকাতে লিখেছেন, ‘বামপন্থার প্রকৃত অর্থ যদি হয় প্রগতিশীল রাজনীতি, তা হলে আমিও নিঃসন্দেহে একজন বামপন্থি। কারণ আমার আদর্শ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতি।’ এই ইতিবাচক ও প্রগতিশীল দিকটি রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান করার ঘটনার মধ্যে অবশ্যই ছিল।
প্রত্যাখ্যান যে কেবল এককেন্দ্রিক স্বৈরাচারী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তা নয়, আন্দোলনে যোগ দিয়ে তরুণ সমাজ অনাস্থা জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠিত বাঙালি নেতৃত্বের প্রতিও। নেতারা কেউ ভাবছিলেন পদ পাওয়ার কথা, কেউ ভাবছিলেন আগামী নির্বাচনে বিজয়ের বিষয়ে। গোলযোগ বাধলে পদ পাওয়া যাবে না, হয়তো নির্বাচনই হবে না, এই ছিল আশঙ্কা। রাজনীতিকরা যা করেন তাই করেছেন, হিসাব করেছেন লাভ-লোকসানের। ছাত্র-জনতা ভাবছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা। ছাত্ররা যেমন শাসকদের ভ্রুকুটিতে ভয় পায়নি, তেমনি প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের নিষেধও মানেনি, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে। তার সুফল অবশ্য ছাত্ররা পাওয়ার আগে ওই নেতারাই পেয়েছেন, তারা মন্ত্রী-মেম্বার হয়েছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সেই মুহূর্তে তারা যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন এটা খুবই বড় বাস্তব সত্য। প্রত্যাখ্যানের সে এক মহামুহূর্ত।
অধস্তনতাকে মেনে না নেওয়ার কারণেই বাংলা ভাষা বিকশিত ও মর্যাদাবান হয়েছে। রাষ্ট্রভাষার অধিকার থেকে তার বঞ্চনাকে মেনে না নেওয়ার কারণেই বাংলাভাষী একটা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। আমরা জাতীয়তাবাদী হয়েছি, যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হচ্ছে বাংলা ভাষা। কিন্তু পুরোপুরি হয়েছে কি? হইনি যে তার স্বচ্ছ প্রমাণ হলো এটি যে, বাংলা ভাষা এখনও সবাই ব্যবহার করে না- অধিকাংশ করে না বাংলা জানে না বলে, একাংশ করে না ইংরেজি জানে বলে। অর্থাৎ অসম্মতির মধ্যে যে সম্মতি ছিল সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।
কিন্তু ভাষা আছে, তার নিরিখ আছে। রয়েছে সে পথপ্রদর্শক হিসেবে। এই পথ সৃজনশীলতার এবং ঐক্যবদ্ধতার। জাতীয়তাবাদী হওয়া অর্থাৎ ঘরে ফিরে পিঠ দিয়ে দরজা আটকে দেওয়া নয়, অর্থ হচ্ছে গৃহকে উন্নত করা, তাকে সংলগ্ন করা প্রতিবেশীর সঙ্গে যেমন, তেমনি সারা বিশ্বের সঙ্গে। সৃষ্টিশীলতা এভাবেই আসে, আসে সংবেদনশীল ঐক্যবদ্ধতা। ইউরোপে ল্যাটিন ভাষার সাম্রাজ্যবাদকে অস্বীকার করে যেমন, তেমনি উপমহাদেশে সংস্কৃত ভাষার আধিপত্যকে অমান্য করে তবেই জাতীয় ভাষা বিকশিত হয়েছে। এই বিকাশের যে সম্ভাবনা, তার কোনো সীমা নেই।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ভাষার আকাক্সক্ষাটা সমাজতান্ত্রিক। এটা সত্য যে, সমাজতন্ত্র ব্যাপারটাকে খুব স্পষ্ট করা কঠিন। স্বয়ং মার্কস পুঁজিবাদের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে যেমন বিস্তৃত ও বৈজ্ঞানিক, পুঁজিবাদকে প্রত্যাখ্যান যেমন দৃঢ়, সমাজতান্ত্রিক সমাজে চিত্র উপস্থাপনে তেমন পরিষ্কার নন। এখানেও সেই সত্যই প্রতিফলিত- কী চাই না বলাটা সহজ, কী চাই তা বলা কঠিন। কিন্তু ভাষা বলে দিচ্ছে কী চাই। চাই এমন একটি সমাজ যেখানে আমি অথবা তুমি, এই ধরনের সমীকরণ থাকবে না, অঙ্কটা হবে আমাকে এবং তোমাকে মিলিয়ে। আমাদের পরিচয় হবে অভিন্ন। সৃজনশীলতা থাকবে অফুরন্ত। যেখানে মানুষ টাকার ভাষায় কথা বলবে না, বলবে মানবিক ভাষায়। ব্যক্তি অন্যের ভৃত্যে পরিণত হবে না, ব্যক্তি সেবা করবে তার নিজের; বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়, সংলগ্ন হয়ে। অসম্মতির মধ্যে এ এক পথপ্রদর্শক সম্মতি।
গণতন্ত্রের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদকে গণতন্ত্রের পূজারি বলেই মনে হয়। সবাইকে সে নিয়ে আসতে চায় খোলামেলা বাজারে। ভোটের অধিকার দিতেও অনিচ্ছা নেই। কিন্তু তার গণতন্ত্র আসলে বাজারের গণতন্ত্র। দরকষাকষির। সে-ই জিতবে যার ধন আছে। বাকিরা হেরে যাবে, ঠকে যাবে। প্রকৃত অর্থে এ কোনো গণতন্ত্র নয়, ভানমাত্র। ভাষার অধিকার যে গণতন্ত্রের কথা বলে সেটা কেনাবেচার নয়, লাভ-লোকসানের নয়, সে হচ্ছে সর্বজনীন এবং অনিবার্য মানবিক অধিকারের। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্যক্তি-স্বাধীনতার ধ্বনিটি খুব জোরেশোরে উঠেছিল। অনুসন্ধানও চলছিল। স্বাধীনতা কেন দরকার? দরকার প্রধানত ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য। আর বিপদটা ছিল ওইখানেই। ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতা রক্ষা করতে গিয়ে বৈষম্য বেড়েছে, আর এই বৈষম্য অল্পসংখ্যক মানুষকে অধিক স্বাধীনতা দিতে গিয়ে অধিকসংখ্যক মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। ভাষা অবশ্যই ব্যক্তিগত অর্জনে বিশ্বাস করে, কিন্তু সেই অর্জনকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করতে সম্মত হয় না।
গণতন্ত্রের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের বিরোধটা যে একেবারেই মৌলিক তা আমরা বুঝি। গণতন্ত্রের মূল কথা জবাবদিহিতা, আমলাতন্ত্রের মূল শক্তি জবাবদিহিতার অভাব। কিন্তু দেখা গেছে, গণতন্ত্রই আবার আমলাতন্ত্রকে পেছন দরজা দিয়ে ডেকে নিয়ে আসে। পুঁজিবাদী দেশে এটা ঘটে, সমাজতান্ত্রিক দেশেও ঘটেছে। এর কারণটা এই যে মানুষমাত্রই চায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে। ক্ষমতা যারা পেয়েছে তারা ভয় পায় ক্ষমতা নাও থাকতে পারে। ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় তারা আমলাতন্ত্রের সাহায্য নেয়। আমলাতন্ত্র বুদ্ধি জোগায়, সহায়তা দেয়। আর বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তো আছেই, আমলাতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। তারা ওপরে এমন ভাব দেখায় যে, নির্বাচিত সরকার চায়, ভেতরে চায় আমলারা থাকুক কিংবা রাজনীতিকরাই আমলা হয়ে যাক। কেননা আমলাতন্ত্র সর্বদাই অনুগত ও পূর্বপরিচিত। পুঁজিবাদের পক্ষে তাদের মাধ্যমে কাজ করা সুবিধাজনক। আমাদের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন যেমন ছিল স্বৈরাচারবিরোধী, তেমনি ছিল আমলাতন্ত্রবিরোধী। আমলাতন্ত্রের স্বাভাবিক ভাষা বাংলা নয়, সেটি হচ্ছে ইংরেজি। আগে ছিল, এখন অনেকটাই রয়েছে, আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে- যদি না রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আসে, যদি না রাষ্ট্রের ওপর সমগ্র জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর শিক্ষাটা ভাষা আমাদের দেয়। স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন দিয়েছে। তার কোনো ঋণ নেই। আছে প্রত্যাখ্যান। প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বকে সে সরিয়ে দিয়েছে। তার পর আমরা যে এগিয়েছি তা ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই। ভাবালু আন্দোলন নয়; দৃঢ়, অবিচল সংগ্রাম। ওই পথেই প্রত্যাখ্যান ঘটেছে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুসলিম লীগের- চুয়ান্নর নির্বাচনে। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানও ওই পথেই। সত্তরের নির্বাচন আরেক পদক্ষেপ। মুক্তিযুদ্ধ একটি পরিণতি। প্রতিটি স্তরেই জনগণ ছিল মূল নায়ক; সেই জনগণ যাদের ভাষা বাংলা, যারা বাংলা ভাষার পক্ষে সংগ্রামী। কিন্তু মূল নায়ক হলেও জনগণ এখন সংগঠনবঞ্চিত। তাদের সংগঠন নেই। বুর্জোয়া দলগুলোই প্রধান; জনগণের জন্য মুক্তির যে লক্ষ্য, একটি সামাজিক বিপ্লব, সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বুর্জোয়া দলের নেই, ইচ্ছেও নেই। তেমন নেতৃত্বের তাই প্রয়োজন জনগণকে যারা সংগঠিত করবে, ভয় করবে না, আপসের দিকে ঝুঁকবে না। একাধারে সাহসী ও হৃদয়বান হবে। নিপীড়নকে মেনে নেওয়ার যে অসম্মতি তার অন্তরে আছে, আছে যে ইতিবাচকতা, রয়েছে নতুন সমাজ গড়ার যে অঙ্গীকার, তা-ই তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কারও একার কিংবা বিচ্ছিন্ন কোনো শ্রেণির স্বার্থে নয়, সমাজের সব মানুষের স্বার্থে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!