তাজউদ্দীন আহমদকে গৌণ করে রাখা হয়েছে
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল নাম তাজউদ্দীন আহমদ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে কথা হয় বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রণজিৎ সরকার।
আমাদের সময় : তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেছিলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিলেন। তার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : তার গোটা রাজনৈতিক সংগ্রামের পর্বগুলোর বাইরেও তার অক্ষয় অবদান আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে। সেই কঠিন সময়ে সংগ্রামের সব শক্তিকে একতাবদ্ধ রাখা এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদের অবদান ছিল অনন্য। যদিও এত বড় সংগ্রামের ফলাফল কোনো ব্যক্তির ওপর কখনও নির্ভর করে না, তথাপি এ কথা বলতে হয়, তাজউদ্দীন আহমদ বিচক্ষণতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বাংলাদেশের সরকারের কাজের নেতৃত্ব দেওয়া তার দক্ষতা, বিচক্ষণতা এবং রাজনৈতিক গুণাবলির কারণে সম্ভবপর ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ভেতর দিয়ে গড়ে তুলতে হবে নতুন শক্তিকাঠামো। সে জন্য তিনি ষোল ডিসেম্বরের পর দেশে ফিরে এসেই সরকারের পক্ষে নির্দেশ জারি করেন, এখন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবে। সে জন্য থানায় থানায় মিলিশিয়া ক্যাম্প গঠন করা হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের সেখানে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করার আহ্বান জানান এবং বলেন, এদের ভেতর থেকে সেনাবাহিনী, জওয়ান, অফিসার, পুলিশ বাহিনী, অন্যান্য বাহিনী যেমনÑ ব্যাংক, সচিবালয় ইত্যাদি সব রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হবে। আমরাও তখন এই পদক্ষেপকে সমর্থন করি। এই পথে দেশ অগ্রসর হলে ভবিষ্যৎ প্রগতির ধারা অনেক সফলভাবে এগিয়ে যেতÑ এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে এসে এই পথে না চলে পার্লামেন্টে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং পাকিস্তানি কাঠামোকে ভেঙে নতুন প্রশাসনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলার বদলে সেটাকে অবলম্বন করেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ এবং জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথটি তিনি গ্রহণ করেন। ফলে পুরনো ব্যবস্থা এবং কাঠামো অচিরেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পদে পদে আপস, নানা রকমের পদস্খলনের ভেতর দিয়ে সেটা দুর্বল হতে শুরু করে।
আমাদের সময় : বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সরকার বা কোনো দল ও সংগঠনের তেমন কোনো আয়োজন লক্ষ করা গেল না কেন? এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি, কারণ কী?
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : তাজউদ্দীন আহমদকে গৌণ করে রাখা হয়েছে। বুর্জোয়া নিয়মকানুন, রীতিনীতি অনুসারণ করেছে। সেটার ভেতরে অন্যতম হলো সুপ্রিমো সংস্কৃতি, একক নেতা। এই একক নেতার নিচে সবাইকে রাখতে হবে। এবং ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য ও চেতনা সম্পর্কে আওয়ামী লীগও সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তার বয়ান তৈরি করেছে। সেটা যে কেবল বিকৃত ও মিথ্যা ছিল না, কেবল একপেশে এবং আওয়ামী লীগের শাসনকে চিরস্থায়ী করার স্বার্থে, সেটার ফলে সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে একটা বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছিল। এক নেতা, একদলÑ মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই এই ধারাকে তারা এগিয়ে নিয়ে যায়। এটাই পরবর্তীকালে তাজউদ্দীন আহমদের মতো আরও যারা ভিন্নমতের নেতা ছিলেন, তাদের ছোট করে সুপ্রিমো সংস্কৃতিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এবং তারই পরিণতি ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান।
আমাদের সময় : তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত কোনো স্মৃতি?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : মুক্তিযুদ্ধের আগে আমি তাকে দূর থেকে দেখেছি। স্বাধীনতার পর এক-দুইবার দেখা হয়েছিল। তখন পঞ্চবার্ষিকী নিয়ে আলোচনা হয়। সেসব বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। প্রধানত শিক্ষানীতি, শিক্ষাব্যবস্থা ও বাজেট বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা হতো। আওয়ামী লীগ থেকে যখন তাকে বহিষ্কার করা হলো, তখন সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি সাধারণভাবে বলেছিলেনÑ চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন। আমরা কেন আরও শক্তভাবে সরকারের অন্যায়গুলোর প্রতিবাদ করছি না, সেটা আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন।
আমাদের সময় : তাজউদ্দীন আহমদকে বলা হতো তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন। আপনি একজন কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে বিষয়টা কীভাবে দেখেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কোনো সময়ই এ রকম ধারণা ছিল না যে, এই দলে খুব গভীর চিন্তাভাবনা, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, হিসাব-নিকাশ করে কোনো কাজ পরিচালনা করার জন্য দলটা সমৃদ্ধ ছিল। এ রকম কোনো সময়ই কেউ ধারণা করত না। এ অবস্থাতেই আমরা জানতাম যারা এই দলটির ইন্টেলেকচুয়াল উপাদানে সমৃদ্ধ এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে কিছুটা হলেও সক্ষম তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অন্যতম। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকার কারণে তাজউদ্দীন আহমদের ভেতরে শুরু থেকে বামপন্থি রাজনীতির প্রভাব ছিল। একেবারে শুরুর দিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূচনালগ্নে ছাত্র ফেডারেশন এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগ, উদীচী, কমিউনিস্ট প্রভাবিত সংগঠনের সঙ্গে তার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগে থেকেই এই বিষয়গুলো তার ভেতর কিছুটা হলেও স্থান করে নেয়। জাতীয়তাবাদী লোক হওয়া সত্ত্বেও তার ভেতরে বামপন্থি চিন্তাগুলো লালিত হতে থাকে।
আমাদের সময় : তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবন ও আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক এবং তাকে কেন মন্ত্রিপরিষদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো সে সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : আমরা জানতাম আওয়ামী লীগের ভেতরে একটা দক্ষিণপন্থি রক্ষণশীল ধারা, আরেকদিকে কিছুটা গণমুখী আর কিছুটা প্রগতিমুখী ধারা পাশাপাশি বিরাজ করত। তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন প্রগতির ধারার একজন ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীনের বিরোধের পেছনে নানা রকম কারণ আছে বলে বিশ্লেষণ করা হয়। অনেকে অনেক রকম কারণ ব্যাখ্যা করেন। সে বিষয়ে না গিয়েও এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন সাহেবকে ক্যাবিনেট থেকে সরিয়ে দেওয়ার ভেতর দিয়ে যে বিরোধ প্রকাশিত হয়েছে তার ফলে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাধাগুলো আরও শক্তিশালী হবে এবং আওয়ামী লীগের রক্ষণশীল অংশ তাদের আধিপত্য নিয়ে আরও চেপে বসবেÑ এটা সবাই বুঝতে পেরেছে। এটা ছিল বড় রকমের পদস্খলনের বিপদ। যাত্রার শুরু থেকেই তাজউদ্দীন ও বঙ্গবন্ধুর বিরোধ সেই আশঙ্কা আরও গভীর করে তোলে।
আমাদের সময় : তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন। সমাজতন্ত্র অভিমুখী বাজেট বা পরিকল্পতি প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন। আপনি অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে সে বাজেট কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : একটা বিধ্বস্ত অনৈতিক দেশকে পুনর্গঠিত করার জন্য আজকের বিবেচনায় অতি সামান্য পরিমাণ অর্থ নিয়ে তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন আমি বলব কিছু ত্রুটি-বিচুতি থাকলেও সেটা অসাধারণ একটা সাহসী পদক্ষেপ। সেই সময়ের একটা ঘটনা আমি বলতে চাই। আমরা যেভাবে অর্থ সাহায্য পাই, বিশ^ব্যাংকের প্রধান আসার পর তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনার সময় তিনি বলেছিলেন। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলেছিল, আপনাদের কী দরকার আমরা সাহায্য করতে চাই। তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, গোলাবারুদের আওয়াজে আমাদের গরুগুলো দড়ি ছিঁড়ে সব চলে গেছে, এখন চাষবাস করতে অসুবিধা হয়। আপনি আমাদের গরু বাঁধার দড়ি সাপ্লাই দেন। কূটনৈতিক ভাষায় জবাব দেওয়ার ভেতর দিয়ে যে স্যাটায়ার করা হয়েছিল, সেটার ভেতর দিয়ে তাজউদ্দীন সাহেবের শর্তযুক্ত বিদেশি ঋণের বিপদ সম্পর্কে তার যে ধারণা সেটা যেমন স্পষ্ট হয়, সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশকে যে হাত করা যাবে না, ঋণের জোয়াল মুখে লাগিয়ে বাংলাদেশকে হাত করা যাবে না, সেটাও পরিষ্কার হয়। এ ধরনের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতৃত্ব থাকলে হয়তো আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদ ষড়যন্ত্র আমরা মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের দিকে আরও বেশি অগ্রসর হতে পারতাম।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
আমাদের সময় : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : ধন্যবাদ