কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষ ভূমিকা পালন করলেও এই সমাজে একজন অফিস কর্মকর্তার কাছে প্রখর রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে আমাদের জীবনকে সহজ করা একজন রিকশাচালক কিংবা রাজমিস্ত্রির মাথা নোয়াতে হয়।
জীবিকার তাগিদে একশ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষের ভোরের আলো ফোটার আগেই ছুটতে দেখা যায়। কেউ হাতে ঝাড়ু নিয়ে, কারও হাতে চায়ের ফ্ল্যাস্ক, কেউ করছে ফেরি, কেউ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে খবরের কাগজ, কেউ বা যাচ্ছে নতুন কাজের সন্ধানে। শহরের ঘুম ভাঙার আগেই যাদের দিনের শুরু হয়ে যায়, যাদের ছাড়া শহরের চাকা ঘোরে না, কিন্তু শহর কি তাদের চেনে? কেন এত অবজ্ঞা সব কাজের মানুষদের প্রতি। প্রায়ই খবরের কাগজে দেখা যায়, গৃহপরিচারিকার ওপর করা নির্মম অত্যাচারের খবর। কিংবা রাস্তাঘাটে দেখা যায় বাবার বয়সী রিকশাচালকের ওপর অকথ্য ভাষায় করা গালাগাল কিংবা হাত তোলার ঘটনা। এই অবহেলা শুধু ব্যবহারিক নয়, এটি এই সমাজের অন্তঃস্থ মানসিক বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি।
আমরা ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে ‘শ্রমের মর্যাদা’ সম্পর্কে পড়েছি, কিন্তু বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ কজনই বা করে?
তথাকথিত সুশীল সমাজ ‘সবার সমান অধিকার, সমান অধিকার’ বলে নানা রকমের বুলি আওড়ালেও একজন শ্রমিক কিংবা রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের অনেকের ভ্রু কুঁচকে যায়। কিছু স্বার্থলোভী মানুষ মানুষের এই আবেগকে পুঁজি করে তৈরি করছে অতিরঞ্জিত সোশ্যাল মিডিয়া কন্টেন্ট। একটা নির্দিষ্ট শ্রেণিকে তারা হাস্যরসের বস্তু বানিয়ে ফেলেছে। নেই তাদের সম্মান কিংবা কথা বলার অধিকার।
এভাবে একটি শ্রেণির মানুষের মানবিক মর্যাদা ভাঙা হচ্ছে প্রতিনিয়তই। হতে হচ্ছে নানারকম বঞ্চনার শিকার। কেউ কি বলতে পারবে এর শেষ কোথায় কিংবা এর পেছনের কারণগুলো কী কী?
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এর একক নয়; একাধিক কারণ রয়েছে। যেমনÑ আমাদের সমাজে এখনও এই দৃষ্টিভঙ্গি আছে যে, গায়ে খেটে কাজ করা মানেই ‘নিচু স্তরের’ মানুষ। যেমন রাজমিস্ত্রি, ঝাড়ুদার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা গৃহকর্মীদের অনেকেই অপমানের চোখে দেখেন। অথচ এরা ছাড়া সমাজ চলত না। শুধু পড়ালেখা করে যে চাকরি করে, সে-ই ভালো, এই ভুল শিক্ষার কারণে যারা শ্রম দিয়ে সমাজে অবদান রাখে, তাদের অবহেলা করা হয়।
উচ্চবিত্ত বা শিক্ষিত শ্রেণির একটি অংশ নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবেন। এই শ্রেণিবৈষম্য থেকেই গড়ে ওঠে ‘কাজের মানুষ’ বনাম ‘অফিসের মানুষ’ এই ধরনের ভেদাভেদ। মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় সম্মানের শিক্ষা অনুপস্থিতÑ স্কুলে গিয়ে শিশুরা শেখে কীভাবে ভালো রেজাল্ট করবে, কিন্তু শেখে না মানবিকতা, তারা জানে না কীভাবে একজন ঝাড়ুদার বা ডেলিভারিম্যানকেও সম্মান করতে হয়। চলচ্চিত্র, নাটক বা বিজ্ঞাপনে অনেক সময় কাজের মানুষদের হাস্যরসের উপকরণ হিসেবে দেখানো হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষের মনেও তার প্রভাব পড়ে। দীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকায় তার প্রভাব আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। তা ছাড়া শিক্ষাগত, ধর্মীয় ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব তো রয়েছেই।
সমাজের এই চিত্রের বদল ঘটানো কি আদৌ সম্ভব? সবার সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে সমাজের এই চিত্রের বদল ঘটানো সম্ভব।
এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম পরিবর্তন আনতে হবে আমাদের নিজস্ব চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে। পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষাব্যবস্থায়; যেখানে শ্রমের মর্যাদা বিষয়বস্তুটি শুধু পাঠ্যবই পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, প্রয়োগ হবে বাস্তব জীবনেও। ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি আরও গুরুত্বারোপ করতে হবে, যুক্ত করতে হবে মানবিকতা ও নির্মূল করতে হবে অপসংস্কৃতির প্রয়োগ, সচেতন হতে হবে রাষ্ট্র তথা জাতিকে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
সরকারের একার পক্ষে সমাজের এত বড় আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তবে শ্রমিকদের মর্যাদা নিশ্চিতকরণে আইন প্রয়োগ, বাস্তবায়ন ও নীতি-নির্ধারণ করে তাদের প্রতি একটি শ্রদ্ধার ভিত্তি গড়ে তোলা সম্ভব। তা ছাড়া গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে ইতিবাচক তথ্য প্রচারে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
কাউকে শ্রদ্ধা করা কিংবা সম্মান প্রদর্শন করা কোনো কঠিন বিষয় নয়। শ্রদ্ধা কোনো দয়াও নয়। এটি ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার। সমাজের অগ্রগতির জন্য আমাদের প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের ঘামের মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই আমরা জাতি হিসেবে প্রকৃত অর্থেই সভ্য হতে পারব।
জোবায়েদা ইসলাম জয়া : গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা