সংকট ও সমাধান

আশিকুর রহমান
২১ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সংকট ও সমাধান

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে একটি প্রযুক্তিনির্ভর, স্বনির্ভর ও গতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে কারিগরি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। চীন, জাপান, রাশিয়া- এই দেশগুলো তাদের জনশক্তিকে পরিকল্পিতভাবে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রযুক্তি খাতে বৈশ্বিক নেতৃত্বে পৌঁছেছে। আমাদের দেশেও কারিগরি শিক্ষা নিয়ে উচ্চাশা রয়েছে, তবে তা বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে যথাযথ পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও কাঠামোগত সংস্কারে।

সম্প্রতি ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি ও আন্দোলন এই খাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে আরও সামনে নিয়ে এসেছে। এই দাবির মধ্যে ছিল কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন, পাঠ্যক্রম হালনাগাদ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ নানা বাস্তবধর্মী প্রস্তাব। কিন্তু আন্দোলন শেষ হলেও বাস্তব পরিবর্তনের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি এখনও দেখা যায়নি।

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে পাঠদান হয় না। শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ সময় বাসায় অবস্থান করেই পড়াশোনা শেষ করে। ক্লাস হয় না বললেই চলে, ফলে প্রকৃত অর্থে পড়াশোনা তেমন হয় না। একজন শিক্ষার্থী গড়ে মাত্র ৩০ শতাংশ ক্লাস করেই ডিপ্লোমা সম্পন্ন করছে। ব্যবহারিক ক্লাসের পরিস্থিতি তো আরও দুর্বল।

সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। যদিও শিক্ষকদের জন্য অনেক আগে থেকেই এই ব্যবস্থা চালু ছিল, তবু তা নানা জটিলতায় এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থী- দু’পক্ষই ক্লাসে অংশগ্রহণে অনীহা দেখাচ্ছে, যার মূল দায় বর্তায় শিক্ষা বোর্ডের ওপর। এই সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন একটি ডিজিটাল, টেকসই ও স্বচ্ছ চেইন সিস্টেম। এ ছাড়া পরীক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। বোর্ড বারবার একই প্রশ্নপত্র পুনরাবৃত্তি করায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন কিছু শেখানোর বা শেখার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। মিড টার্ম পরীক্ষার খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয় না, উপস্থিতি, ব্যবহারিক এবং সেশনাল নাম্বার প্রকাশেও স্বচ্ছতা নেই। একটি প্রচলিত ধারণা হলো- শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে নম্বর পাওয়া যায়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

ফল তৈরিতে উপযুক্ত সফটওয়্যার বা সিস্টেম না থাকায় ফল প্রকাশে বারবার সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়াও প্রশ্নপত্রে এমন অপ্রাসঙ্গিক বিষয় যেমন- ‘ভিএলসি প্লেয়ার ইনস্টল করার ধাপ কয়টি?’- এসে পড়ে, যা কারিগরি শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাই অবিলম্বে যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরি করতে হবে, যেখানে থাকবে আধুনিক প্রযুক্তি, আত্মকর্মসংস্থান এবং শিল্পের প্রয়োজনীয় দক্ষতা।

প্রতিবছর হাজার হাজার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার পাস করলেও তাঁদের বাস্তব প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। শুধু ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার নয়, দক্ষ শিক্ষক সংকটও সমানভাবে ভাবনার বিষয়। গুণগত মান নিশ্চিতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের গণিত ও বিজ্ঞানে দক্ষতা যাচাই করা প্রয়োজন। পাশাপাশি পলিটেকনিক শিক্ষার সামাজিক সম্মান পুনরুদ্ধারে নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ। সমাজে এখনও একটি ভুল ধারণা প্রচলিত যে, দুর্বল শিক্ষার্থীরাই কারিগরি শিক্ষায় আসে- এই দৃষ্টিভঙ্গি ভাঙতে হবে।

বর্তমানে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে অনেক টেকনোলজি থাকলেও সে অনুযায়ী চাকরির সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ, সিভিল টেকনোলজির জন্য ১০০টি পদের বিপরীতে কম্পিউটার টেকনোলজির পদের সংখ্যা হয়তো ১টি বা একেবারেই নেই। ফলস্বরূপ শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ছে। আরও বড় সমস্যা হচ্ছে, কারিগরি খাতে ডিপ্লোমাধারীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

ডিপ্লোমা শেষ করে উচ্চশিক্ষার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। দেশে নতুন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অথবা বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বোপরি, দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে প্রয়োজন একটি সমন্বিত, যুগোপযোগী এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। কারিগরি শিক্ষাকে জনপ্রিয় ও সম্মানজনক করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, আগ্রহ এবং বাস্তবায়নের সাহস। তবেই গড়ে উঠবে স্মার্ট বাংলাদেশ- একটি প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত দেশ, যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম।


মো. আশিকুর রহমান : ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট