আমেরিকার প্রধান অস্ত্র ডলার ব্রিকসের নিশানায়
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্রিকসকে "আমেরিকাবিরোধী" জোট হিসেবে দেখছেন এবং এর সম্প্রসারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার এই বক্তব্যকে ব্রিকস নিয়ে আমেরিকার ভয়ের একটি প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি যদি বলা হয় তাহলে মনে হয় খুব বেশি বড় ভুল হবে না। ব্রিকসকে আসলে এত ভয় কেন বিশ্ব মোড়লের? জোটের বিষয়ে অবশ্য দুই দশক আগে থেকে উদ্বেগে দেশটি। কারণ ডলারের একক আধিপত্য হুমকির মুখে।
দুই দশক আগে ব্রিকসের যাত্রা শুরু হলেও নয়া জোটটি ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। বলা যায় শক্ত ভিত্তি তৈরির কাজ করে যাচ্ছে এখনো। যেন ডলারকে ধাক্কা দিলে ফেলে দিতে পারে। যেন তেন ভাবে ধাক্কার পক্ষে নয় জোটের শীষ দেশ চীন, রাশিয়া আর ভারত।
এক কথায় বললে, আমেরিকার মূল ভয়টি ডলারের বিশ্বব্যাপী প্রভাব হারানোর আশঙ্কার মধ্যেই লুকায়িত এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ারও দরকার নেই। তবে এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন বিশ্ব অর্থনীতির বিরাট অংশ ব্রিকসের দেশগুলো অধিনে চলে আসবে। তাই বাছাই করে অর্থনৈতিক সম্পদ সমৃদ্ধ ও উৎপাদনমুখি দেশগুলোকেই জোটের সদস্য পদ দিচেছ ব্রিকস। পাশাপাশি লক্ষ্য ডলারের বিকল্প মুদ্রা চালুর।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো যদি নিজেদের মধ্যে একটি অভিন্ন মুদ্রা চালু করে, তাহলে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের আধিপত্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই সম্ভাবনাই মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সবচেয়ে বেশি ভীত করছে। বিভিন্ন সুত্রগুলো চীনের ডলার মজুদের যে তথ্য দিচ্ছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে তো সত্যি সত্যি ডলারের জন্য অশুভ দিন অপেক্ষা করছে। চীন তাদের সুবিধামত সময়ে যদি ‘সেই তিন ট্রিলিয়ন ডলার’ নিয়ে খেলা শুরু করে তখন তো নিরুপায় আমেরিকাকে দর্শক হয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। চীন যদি তার সুবিধামত সময়ে বিশ্ববাজারে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের প্রবাহ সৃষ্টি করে তাহলে অনেক ছোটখাটো দেশ তো মুদ্রাস্ফতিতে নিমজ্জিত হয়ে যাবে।
কারণ শুধুমাত্র চীনের ডলার মজুদই নয়। ব্রিকসের দেশগুলো (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া,চীন,দক্ষিন আফ্রিকা,ইজিপট, ইরান,ইনোনেশিয়া,ইথোপিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত,সৌদি আরব) ও সহযোগীরা (বেলারুশ, বলিভিয়া, কিউবা, কাজাকিস্থান, মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড, উগান্ড, কাজাকিস্থান) পৃথিবীর ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ ভূমির মালিক।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এই দেশগুলোতে বসবাসকারীরা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪৫ দশমিক ২ শতাংশ। রপ্তানীতে ২৪ দশমকি ৫ শতাংশ আর শিল্প উৎপাদনে এই দেশগুলোর অবদান সারাবিশ্বের উৎপাদনের ৩৯ দশমকি ৩ শতাংশ।
প্রত্যাশা করা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি বিশ্ব অর্থনীতির ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করবে। বর্তমানে আমেরিকার জিডিপি বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ২৪ শতাংশ হলেও, ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন প্রায় ৩৫ ট্রিলিয়ন ডলার। যা আমেরিকার ২৫ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপির চেয়ে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার বেশি। এই অর্থনৈতিক ক্ষমতার স্থানান্তর আমেরিকার জন্য নিঃসন্দেহে উদ্বেগের কারণ।
আমেরিকার মুদ্রা ডলারের প্রভাব রয়েছে ভূ-রাজনৈতিতেও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ডলারকে আন্তর্জাতিক মূদ্রায় রূপ দিয়ে পরাশক্তির আসন পোক্ত করেছে ট্রাম্পের দেশ। ডলারের মাধ্যমে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমেরিকার অন্যতম প্রধান ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার। ডলারের প্রভাব কমে গেলে বিশ্ব মঞ্চে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে এটাও সরল সমীকর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়া, চীন, ভারত এবং এমনকি বাংলাদেশের মতো দেশগুলো ডলারকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের মধ্যে ভিন্ন মুদ্রায় লেনদেন শুরু করেছে। সেখানে ব্রিকস যদি তাদের মধ্যে নিজস্ব বা অভিন্ন মুদ্রার প্রচলন করে তাহলে অমেরিকার ভয় বা আশঙ্কায় থাকার যথেষ্ট কারণ আছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এবারের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনুপস্থিত ছিলেন। এটা নিয়ে মৃদু আলোচনা হলেও তেমন কোন প্রভাব পরেনি মূল সম্মেলনে। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই যে, চীন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে উপস্থিত থাকলে বিশ্ব গণমাধ্যমে তাদের নিয়ে একটা ভিন্ন ওয়েব তৈরি হতো।তারা যা কিছু বলতেন তাই হয়েতো গণমাধ্যমগুলোরি শীর্ষ শিরোনাম হয়ে উঠে আসতো। তা হয় নি। তবে এই দুই নেতা না থাকলেও ব্রিকস্ তার গতি পথেই এগিয়ে যাচ্ছে বলা যায়। তাদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ব্রিকসের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত নয়। বরং জোটের সম্প্রসারণ এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়েই মূল আলোচনা কেন্দ্রীভূত ছিলো। সংক্ষেপে বলতে গেলে ব্রিকসের অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি এবং ডলারের বিকল্প মুদ্রা চালুর সম্ভাবনা আমেরিকার জন্য প্রধান উদ্বেগের কারণ।
১৭তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনেই দেশগুলোর নেতারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসী বাণিজ্য শুল্কের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদও করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের "বাছবিচারহীন" বাণিজ্য শুল্ককে অবৈধ এবং বিশ্ব বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ মনে করেন তারা। দেশটির অন্যায্য আমদানি শুল্কের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান জানাতেও প্রস্তুত ব্রিসক সদস্যরা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতারা পশ্চিমা আধিপত্য নিয়ে গুরুতর উদ্বেগের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির উপায় নিয়ে আলোচনা করছেন। ব্রিকস নিজেদেরকে "গ্লোবাল সাউথ" বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তুলে ধরছে এবং একটি বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টি করছে। ১৭তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা ইসরায়েলকে গাজায় "গণহত্যাকারী" আখ্যায়িত করে সম্মেলন শুরু করেছিলেন। ব্রিকস জোটের সদস্যরা ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের "বিনা উসকানিতে" সামরিক আগ্রাসনের আনুষ্ঠানিক নিন্দাও জানিয়েছে।যা জোটভুক্ত দেশগুলোর বিশেষ বার্তাও বহন করে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!