শব্দদূষণ প্রতিরোধে সচেতন হই
শব্দদূষণ আমাদের ব্যস্ত ও আধুনিক বিশ্বে একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে শব্দের ভয়াবহতা একটি বেদনাময় অভিজ্ঞতা। না চাইতেই সর্বত্র অনাকাক্সিক্ষত শব্দের প্রবহমানতা পরিবেশকে যন্ত্রণাময় করে তোলে। শব্দদূষণ একটি অবাঞ্ছিত ও ক্ষতিকর বিষয়, যা মানুষের জীবনকে কষ্টের মধ্যে নিয়ে যায়। এটি একটি নীরব ঘাতকও বটে। এটি পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। শব্দদূষণের বিভিন্ন কারণ আছে, যেমনÑ যানবাহন থেকে সৃষ্ট মাত্রাতিরিক্ত উচ্চ হর্নের শব্দ, শিল্প-কারখানার শব্দ, নির্মাণকাজের অকারণ শব্দ, মাইকের উচ্চ শব্দ, বাসাবাড়িতে সাউন্ড সিস্টেমের শব্দ, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের মাইকের শব্দ।
শব্দদূষণের কারণে সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে। শব্দদূষণ মানবস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শ্রবণশক্তি হ্রাস বা বধিরতা, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বৃদ্ধির ঝুঁকি, ঘুমের সমস্যা, কাজের ক্ষমতা কমে যাওয়া, বিরক্তি এবং অসহ্য অস্থিরতা।
শব্দদূষণ মানুষকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনি বন্যপ্রাণী এবং বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করেছে। অত্যধিক শব্দ জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রাণীদের বাসস্থানও বিনষ্ট হচ্ছে অত্যধিক শব্দের কারণে। শব্দের কারণে গ্রামে ও শহরে পাখি কমে যাচ্ছে। মৌমাছি ও পাখি না থাকলে পরাগায়ন হয় না, পরাগায়ন না হলে গাছের বৃদ্ধি ঘটে না। শহরগুলোতে প্রতিদিন শুধু গাছের পাতায় প্রচুর পরিমাণে ধুলাবালু পড়ছে।
শব্দদূষণ থেকে মুক্ত থাকার একটি সহজ উপায় হলো প্রচুর গাছপালা রোপণ করা। গাছপালা শব্দ শোষণে সাহায্য করে, তাই সবার উচিত বেশি করে গাছ লাগানো। বনায়নে শব্দদূষণ কমে এবং পরিবেশ আনন্দময় ও প্রশান্ত হয়।
শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় অমনোযোগী হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি পাঁচজনে একজন কানে কম শোনে। যারা কানে কম শুনছে, তাদের ৮০ শতাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করে। অনেক দিন ধরে তীব্র শব্দ শুনে মানুষের ধৈর্যশক্তিও কমে যাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় শব্দে শিক্ষার্থীরা অস্থির ও অমনোযোগী হয়ে পড়ে। এ তো গেল শিক্ষার্থীদের কথা। প্রতিনিয়ত অকারণ শব্দ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো হর্নের শব্দ। রাস্তায় গাড়ি নামলেই কে কত বেশি হর্ন বাজাতে পারবেৎ, এই প্রতিযোগিতা যেন শুরু হয়ে যায়। এতে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও হাসপাতালে রোগী আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তীব্র হর্নের শব্দে। হাসপাতালের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অনেক গাড়ি অকারণে হর্ন বাজিয়ে যায়, যা না হলেও চলে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আমরা অনেকেই জানি, শব্দের কারণে আমাদের প্রত্যেকের স্বাস্থ্যহানি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। এ জন্য হর্ন বাজানোকে বহুমাত্রিক সমস্যা হিসেবে দেখা দরকার। একই সঙ্গে বলতে পারি, হর্নের ভয়াবহতা উৎপাদনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলছে এবং নিয়মিত ঘুমের ব্যাঘাতের কারণে শ্রমিকরা ঠিকমতো কাজ না করতে পারলে উৎপাদনও কমে যায়।
অকারণে হর্ন মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে, অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এর ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ছে। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ সমস্যা ও গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে সন্তানের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। দীর্ঘ মেয়াদে শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এসব বিষয়ে চিকিৎসার জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। আমরা কেউ চাই না যে অকারণে হর্ন বাজুক। অযথা হর্ন দেওয়ার অভ্যাস বদলাতে হবে। এ জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। হর্ন না বাজানোর জন্য আমাদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন আনা দরকার।
সব দিক বিবেচনা করে আমরা অযথা হর্ন বাজানো বন্ধ করতে পারি। তার মধ্যে একটি হলো, খেয়াল রাখতে হবে, চালকরা যেন অকারণ হর্ন না বাজান, যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে তা বন্ধ করতে হবে।
অন্যটি হলো, নগর পরিকল্পনা ও আইন প্রণয়ন করা। উবারে এক ছাতার নিচে বহু চালক রয়েছেন। আমাদের পক্ষে তাদের কাছে পৌঁছানো সহজ। তাদের বোঝাতে হবে যে শুধু সচেতন হলেই একটি জাতিকে তারা সুস্থ রাখতে পারে। ধীরে ধীরে সব চালকের মধ্যে এই ভাবনা ছড়িয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে এবং হাঁটা বা সাইকেল চালানোর মতো সক্রিয় গতিশীলতার বিকল্পগুলোকে উৎসাহিত করে গাড়ির শব্দদূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যায়।
শব্দদূষণ থেকে মুক্তি পেতে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের দেশের নাগরিকরা যখন বিদেশে যান কিংবা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করেন, তখন তাদের ব্যবহার এক রকম আর দেশের অন্যান্য সড়কে তা আরেক রকম। এর পরিবর্তন প্রয়োজন। এ জন্য সবার মধ্যে শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে কীভাবে শব্দমুক্ত জীবন যাপন করা যায় এবং এর উপাকারী দিকটিও। গাড়ির হর্ন কম ব্যবহার করতে হবে। গাড়ির ইঞ্জিন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। ফিটনেসহীন গাড়ি যেন রাস্তায় না নামে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
শিল্প-কারখানার যন্ত্রপাতি সাউন্ডপ্রুফ রাখতে হবে। নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। আবাসিক এলাকায় মাইক, লাউড স্পিকার, সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দসীমা নির্ধারিত রাখতে হবে।
বাসাবাড়ি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালে শব্দনিরোধক দরজা-জানালা ব্যবহার করা উচিত। তা ছাড়া হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালত ইত্যাদি এলাকাকে বিশেষ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত, যেন এসব এলাকায় হর্ন বাজানো না হয়। অন্য কাজকর্ম করার সময় যেন শব্দ নিরোধ করা হয় তা-ও খেয়াল রাখতে হবে।
ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল বিশ্বে স্মার্টফোন ও হেডফোনের মতো ব্যক্তিগত ডিভাইসগুলো সর্বত্র ব্যবহার করতে হচ্ছে। অনেকের অভ্যাস আছে রাস্তায়, পার্কে এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উচ্চ স্বরে কথা বলা। বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে ফোন ব্যবহারকারীরা যুক্তিসংগত ভলিউমে হেডফোন ব্যবহার করতে পারে এবং হোটেল, রেস্তোরাঁ ও পার্কের মতো পাবলিক স্থানে উচ্চ স্বরে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আমরা নানাভাবে এর প্রতিকার করতে পারি। স্কুল-কলেজ, আফিস-আদালতে সেমিনার করে, লিফলেট বিতরণ করে, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি। এ নিয়ে রেডিও-টেলিভিশনেও প্রচার করা যায়। সবাইকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, শব্দদূষণ একটি গুরুতর সমস্যা, যা আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মোকাবিলা করা যায়। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোকে ‘নীরব এলাকা’ চিহ্নিত করতে হবে এবং সে বিষয়ে সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, সুস্থতার জন্য, মেধার উন্নয়নের জন্য, উৎপাদনশীলতার জন্য আমাদের দেশকে অকারণ শব্দমুক্ত রাখতে হবে। এ জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং একযোগে কাজ করতে হবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
শেলী সেনগুপ্তা : কবি ও প্রাবন্ধিক