পরিকল্পিত ব্যয় ও টেকসই ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট কখনোই কেবল বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়। একটি প্রতিষ্ঠান কতটা দূরদর্শী, জবাবদিহিমূলক এবং জাতি গঠনে প্রতিশ্রুতিশীলÑ তার প্রতিফলন বাজেট। যদি শিক্ষা ও গবেষণা একটি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটই হলো সেই মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় রাখার মূল চালিকাশক্তি। এই বাস্তবতা অনুধাবন করেই বর্তমান সময়ে আমাদের বাজেট পরিকল্পনায় আরও সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকর রূপরেখা গ্রহণ করা হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৯৫,৬৪৪ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের প্রায় ১১.৮১ শতাংশ। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রস্তাব করেছে ১৩,২২২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি। যদিও এই পরিমাণ বাজেট কিছুটা আশার সঞ্চার করে, তবু প্রশ্ন থেকে যায়Ñ এই বাজেট কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহার হবে এবং তার প্রভাব কতটা ফলপ্রসূ হবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট তিনটি মূলস্তম্ভকে কেন্দ্র করে সাজানো উচিতÑ শিক্ষার মান, গবেষণার গুণগত দিক এবং শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ। শুধু অবকাঠামো নির্মাণ বা প্রশাসনিক ব্যয়ের নামে বাজেট খরচ করে ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) ভিন্ন। কেননা এটি ফেস টু ফেস নয় বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দূরশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভক্তÑ সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের চাহিদা, কাঠামো, গবেষণার পরিধি ও শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল অনুযায়ী বাজেট পরিকল্পনাও হয় পৃথক ও লক্ষ্যভিত্তিক।
উদাহরণস্বরূপ, কৃষি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ল্যাব ও গবেষণা খাতভিত্তিক খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি। তাদের বছরে প্রায় পুরো সময় গবেষণামূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর কার্যক্রম চলমান থাকে। তাই শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় গড়ে চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা। অন্যদিকে, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) একটি দূরশিক্ষণভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় মাত্র ৩,০০০Ñ৩,৫০০ টাকা। কিন্তু এখানেও চ্যালেঞ্জ রয়েছেÑ মানসম্পন্ন শিক্ষার সরবরাহ নিশ্চিত করা, পাঠ্যসামগ্রী হালনাগাদ করা, অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা প্রযুক্তির উন্নয়ন ইত্যাদি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বিগত আমলের পত্রিকা খুললেই আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির নানা চিত্রের প্রতিবেদন দেখা যায়। এগুলোর অন্যতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট খাতে সঠিকভাবে অর্থ বরাদ্দ, যথোপযুক্ত ব্যবহার, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি। তাই কর্মপরিকল্পনাভিত্তিক বাজেট বাস্তবায়নে কয়েকটি ভিত্তি লক্ষ করা যায়। পরিকল্পনাভিত্তিক বাজেট বাস্তবায়নের পাঁচটি লক্ষ্যমাত্রা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।
শিক্ষার মানোন্নয়ন : শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে স্মার্ট ক্লাসরুম, আপডেটেড কারিকুলাম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, অনলাইন লাইব্রেরি ও বৈদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ কারিকুলাম উন্নয়নের উদ্যোগ থাকা আবশ্যক। পাঠ্যপুস্তকের আধুনিকীকরণ, শেখার পদ্ধতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ফলাফলনির্ভর শিক্ষা নিশ্চিত করতে বাজেট ব্যয় করা উচিত। শিক্ষকের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামও এ খাতে যুক্ত করা যেতে পারে।
গবেষণা ও উদ্ভাবন : একটি বিশ্ববিদ্যালয় তখনই বিশ্বমানে পৌঁছায়, যখন গবেষণার গুণগত মান বাড়ে এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়। গবেষণা অনুদান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনার জন্য সহায়তা, গবেষণাগার আধুনিকীকরণ এবং স্থানীয় সমস্যাভিত্তিক গবেষণার অগ্রাধিকার প্রয়োজন। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রকৃতি, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রযুক্তিÑ এসব খাতে বাস্তবভিত্তিক গবেষণা একটি দেশের সঠিক নীতিনির্ধারণেও ভূমিকা রাখে।
শিক্ষার্থী ও কর্মীকল্যাণ : বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হওয়া উচিত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের কল্যাণে। এখানে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেÑ কোয়ার্টারসহ আবাসন সুবিধা, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যসেবা, স্কলারশিপ, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং, ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম এবং নন-একাডেমিক সহায়তা। দরিদ্র ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নির্বিঘ্ন করতে পর্যাপ্ত তহবিল ও প্রণোদনা থাকা জরুরি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা : বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ে বাংলাদেশের আপামর ও মেহনতি মানুষের ঘামে ভেজা অর্থ যুক্ত থাকে, তাই এই অর্থ ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা নৈতিক দায়িত্ব এবং অপরিহার্য কর্তব্য। অতীতে দেখা গেছে, কিছু অপ্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণ, ল্যাব খাতে দুর্নীতি বা আত্মীয়করণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব থেকে রক্ষা পেতে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা, সময়সীমা, অগ্রগতি প্রতিবেদন এবং বাইরের নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। বাজেট ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণার আশা করা যায় না।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও জ্ঞানবিনিময় : আজকের বিশ্বায়নের যুগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সাফল্যই যথেষ্ট নয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এমওইউ, যৌথ গবেষণা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচি, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ, বৈদেশিক স্কলারশিপÑ এসব একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র্যাংকিং ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক। বাজেটের একটি অংশ পরিকল্পিতভাবে এই খাতে বরাদ্দ করা সময়ের দাবি। ১৯৯২ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। তিন দশকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সভা-সেমিনার, চুক্তিসহ নানা কর্মসূচিতে বেশ এগিয়েছে বাউবি।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারেÑ যেখানে বাজেট শুধুই চাহিদানির্ভর নয়, বরং লক্ষ্যভিত্তিক এবং কর্মপরিকল্পনা-সমন্বিত। নিয়মিত-অনিয়মিত মিলিয়ে বাউবিতে ৯ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার, বয়সের এবং ভৌগোলিক অবস্থানের। উপাচার্য ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, ‘বাজেট ব্যয় করতে হবে নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে, যাতে প্রতিটি দপ্তর নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।’
বাজেট মানে বিনিয়োগ, খরচ নয়। আমরা যদি সত্যিই একটি জ্ঞানভিত্তিক ও উদ্ভাবননির্ভর অর্থনীতি গঠনের স্বপ্ন দেখি, তবে বিশ্ববিদ্যালয় বাজেট হতে হবে দৃষ্টিভঙ্গিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও টেকসই ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল। কেবল বছর শেষে অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য বাজেট নয়Ñ এই বাজেট হতে হবে জাতি গঠনের এক বাস্তব রূপরেখা। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, বাজেট পাস হওয়ার পর আসল কাজ শুরু হয়। কীভাবে এই অর্থ ব্যয় হলো, কতটা ফল দিচ্ছে, কারা উপকৃত হচ্ছেÑ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার সক্ষমতা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকে, তাহলেই এটি হবে একটি দায়িত্বশীল ও গণমুখী প্রতিষ্ঠান।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
তাই বলা যায়, বাজেট যত বড়ই হোক না কেন, তার কার্যকারিতা নির্ভর করে তার পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট একসঙ্গে চেতনা, চর্চা ও চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন, যেখানে অনুপ্রেরণা আসে শিক্ষার আলো থেকে, দায়বদ্ধতা আসে জনগণের আস্থা থেকে এবং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ তৈরি হয় বর্তমানের পরিকল্পনা থেকে।
ড. আবুল হাসনাত মোহা. শামীম : অধ্যাপক ও ট্রেজারার, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়