কৃষি ও কৃষকের ভবিষ্যৎ কোথায়
স্বাধীন বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল কৃষিজমি, কৃষি ও কৃষককে রক্ষা করা। সেই কারণে জমির মালিকানার সীমা ঠিক করা হয়েছে, যাতে জমির ওপর কোনো ধনী বা শক্তিশালী গোষ্ঠীর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ না হয়। এতে কৃষকের ভবিষ্যৎ নিরাপদ থাকার কথা ছিল। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে এই আইনের অপব্যবহার ও কিছু ব্যতিক্রমের সুযোগ নিয়ে কি ধনী, প্রভাবশালী বা করপোরেট কোম্পানি কৃষিজমি দখল করছে? কৃষক কি আবারও জমি হারানোর পথে? আমাদের কৃষি ও কৃষিজমি কি আস্তে আস্তে ধনী, প্রভাবশালী বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাচ্ছে? এই আশঙ্কা কতটুকু বাস্তব, এই লেখায় সে দিকেই নজর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমির ওপর চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ জনগণ এখনও কোনো না কোনোভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। এই বাস্তবতা বিবেচনা করে দেশটির ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন অনেক আগে থেকেই মালিকানার সীমা কাঠামোতে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা নির্ধারণ করে রেখেছে। তবে এই আইনে কিছু ব্যতিক্রম বিধান সংযোজিত করা হয়েছে, যেখানে সরকার, কোম্পানি বা ফার্মের, সমবায় সমিতির, কৃষি বা শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য মালিকানার সীমা শিথিল করতে পারে। এই ব্যতিক্রম বিধানগুলো একদিকে উন্নয়নের যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য মনে হলেও বাস্তবে এগুলো প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে জমি কুক্ষিগত করার এক প্রকার আইনি সুযোগ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে প্রান্তিক কৃষকরা জমিহীন হয়ে পড়ছে, সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। ভূমি মালিকানার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে জমির সুষম বণ্টন ও ভূমিহীনতা রোধের জন্য এবং কৃষক ও কৃষিব্যবস্থা সংরক্ষণে।
আইনি শিথিলতার সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো বেনামি লেনদেন এবং বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে নির্ধারিত সীমার বাইরেও জমি কুক্ষিগত করছে। আবাসন ব্যবসায়ী, বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো, কৃষি-ব্যবসা এবং কৃষি-মৎস্য খাতে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো, ভূমি দখলের অন্যতম প্রধান অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা প্রায়ই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বা প্রলোভন ব্যবহার করে কৃষকদের কাছ থেকে জমি দখল করে।
ভূমিকেন্দ্রিক অনাচারের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে, বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবারগুলোর ভূমিহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার ১০%-এর হাতে ৮০% জমি রয়েছে। গ্রামীণ বাংলাদেশে ৫% পরিবারের হাতে ২৬.৪% এবং ১০%-এর হাতে ৩৯.৭% আবাদযোগ্য জমি রয়েছে। ২০২৪ সালের ওঋচজও-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫৬% গ্রামীণ পরিবার ভূমিহীন। বিভিন্ন গবেষণায় ও পত্রিকার রিপোর্ট মতে, ‘সরকার কর্তৃক ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণকৃত খাসজমিও প্রভাবশালীরা পুনরায় গ্রাস করে নিয়েছে, যা ভূমিহীনদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় বাধা বটে।’
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে কৃষিজমি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে কৃষিজমিতে বৃহৎ প্রকল্পগুলোর সীমাহীন উল্লম্ফন আমাদের কৃষির ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ করছে? সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মতো উদ্যোগ নিয়েছে, যার জন্য বিপুল পরিমাণ জমির প্রয়োজন হয়, যা প্রায়ই প্রচলিত নীতির তোয়াক্কা না করে, কৃষিজমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে পূরণ করা হয়। প্রতিবছর প্রায় ২,৫০০-৩,০০০ হেক্টর উর্বর কৃষিজমি অকৃষি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জানুয়ারি ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কৃষিপেশায় জড়িত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ কমেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে অনেক কৃষক কৃষিপেশা ছেড়ে অন্য জীবিকার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভূমি মালিকানার সীমা নির্ধারণের আইনগত কাঠামো থাকা সত্ত্বেও করপোরেট কৃষির বিস্তার এবং আইনি শিথিলতার অপব্যবহারের কারণে কৃষিজমির নিয়ন্ত্রণ ও চরিত্র পরিবর্তন অব্যাহত রয়েছে। এটি প্রান্তিক কৃষকদের জমিহীন করে তুলছে, কৃষিজমি হ্রাস করছে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। আমরা চাই নিশ্চিত কৃষিজমি, কৃষক ও হাজার বছরের কৃষি ঐতিহ্যের সংরক্ষণ।
বাংলাদেশের করপোরেট কোম্পানিগুলো (বীজ কোম্পানি, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং প্রতিষ্ঠান) কৃষকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে ঠিক একইভাবে। সরকারি নীতির ব্যতিক্রম, নমনীয়তা বা আইনগত গ্রে এরিয়া, এতে সহায়ক ভূমিকা রাখছেÑ এর ভবিষ্যৎ কোথায়? আশঙ্কা বাড়ছে, নীল চাষের ইতিহাস কী আবার ফিরে আসবে?
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
করপোরেট সংস্থাগুলো সরাসরি বৃহৎ কৃষিজমির মালিক না হয়েও চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। কোম্পানিগুলো বীজ, সার, ওষুধ সরবরাহ করে এবং উৎপাদিত পণ্য নির্দিষ্ট মূল্যে কিনে নেয়, যা কৃষকদের করপোরেট সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সম্প্রতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ‘চুক্তিভিত্তিক চাষ’ (ঈড়হঃৎধপঃ ঋধৎসরহম) এবং হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের প্রকল্পগুলো করপোরেট নিয়ন্ত্রণের বাস্তব উদাহরণ। এর ফলে একদিকে কৃষক বীজ, সার ও কৌশলনির্ভর হয়ে পড়ে করপোরেটের ওপর, অন্যদিকে জমির ওপর নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারও হারিয়ে ফেলে। এই দখলদারি ধীরে ধীরে ভূমির সামাজিক চরিত্র ও উৎপাদন কাঠামোকে বদলে দিচ্ছে।
কৃষি বাংলাদেশের প্রাণ, কৃষক বাংলাদেশের মেরুদণ্ড। অথচ যুগে যুগে কখনও নীলকর, কখনও জমিদার আর আজ করপোরেট লোভের জালে কৃষক ও কৃষিজমি বিপন্ন। আজ আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কি আবারও কৃষি ও কৃষকের অধিকার হারানোর দিকে এগোচ্ছি? নাকি সময় এসেছে শক্ত হাতে ভূমি, কৃষক ও কৃষির অধিকার সংরক্ষণের? দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের মর্যাদা আর হাজার বছরের কৃষি ঐতিহ্য রক্ষায় এখন প্রয়োজন নীতিনির্ধারক, সমাজ ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত, কঠোর পদক্ষেপ। কৃষি, কৃষক ও কৃষিজমি যেন কাপোরেট লোভের শিকার না হয়Ñ তার জন্য চাই উপযুক্ত করপোরেট কৃষি নিয়ন্ত্রণ, কৃষিজমি ও কৃষিব্যবস্থা সংরক্ষণ আইন।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
কাজী লতিফুর রেজা : সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও মানবাধিকার বিভাগ, আরপি সাহা বিশ্ববিদ্যালয়