ওষুধ সুলভমূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করুন

মো. ছায়েদুল হক
১৬ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ওষুধ সুলভমূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করুন

সবার জন্য স্বাস্থ্য অথবা স্বাস্থ্য সবার অধিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই চার্টারে বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। সেই হিসাবে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার এক ধরনের বাধ্যবাধকতা স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে সরকারের আছে। ১৯৭৮ সালে আলমা আতা সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রাইমারি স্বাস্থ্যসেবাকে আবশ্যিক উপায় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ভড়ঁৎঃববহঃয এবহবৎধষ চৎড়মৎধসসব ড়ভ ড়িৎশ (এচড-১৪) কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেমন স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে প্রাইমারি স্বাস্থ্যসেবায় অর্থায়নে জোর দিতে হবে। জরুরি চিকিৎসা সক্ষমতায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে। চিকিৎসাব্যয় সীমিত রাখতে হবে, যাতে চিকিৎসার সরঞ্জাম এবং চিকিৎসা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে না পড়ে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে ১৯৯৮ সালে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। উল্লেখিত চার্টারে একজন নাগরিক তার সর্বোচ্চ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকার রাখে। এটি নিশ্চিত করার দায় রাষ্ট্র তথা সরকারের। এটি নিশ্চিত করতে যথাযথ অর্থায়ন ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। অর্থায়নে টানাপড়েন থাকলে অথবা পরিকল্পনার ঘাটতি থাকলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য কোনোটিই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একটি দেশ। তেমন একটা স্বচ্ছ পরিকল্পনাও এখানে দৃশ্যমান নয়। তা হলে এখানে স্বাস্থ্যসেবার হালহকিকত কী? স্বাস্থ্যসেবা কি আদৌ সবার জন্য অবারিত হওয়া সম্ভব?

এখানে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে চাই। কদিন আগে আমার এলাকা থেকে একজন রোগীকে নিয়ে বাবা-মা হাজির। রোগী দুই মাসের শিশু। দম্পতির আগের সন্তানটি কয়েক মাস আগে দুই বছর বয়সে মারা যায় চোখের টিউমারসংক্রান্ত জটিলতায়। চিকিৎসা করিয়েছিলেন। চিকিৎসা চলাকালীন শিশুটির মৃত্যু হয়। চক্ষুচিকিৎসক রোগীকে উপদেশ বা কাউন্সেলিং করেছিলেন যেন পরবর্তী সন্তান জন্ম নিলে তাকে যেন চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেন। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই ওই টিউমারটিতে বংশানুক্রমিক বা পারিবারিক প্রভাব কাজ করে। দ্রুত শনাক্ত হলে চিকিৎসা ও জীবন রক্ষা দুটিই সম্ভব। বাবা-মা জন্ম নেওয়া পরে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিতে গেলে দ্বিতীয় সন্তানটিরও একই সমস্যা শনাক্ত হয়। তাই শিশুটিকে একটি টার্সিয়ারি হাসপাতালের সঙ্গে ট্যাগ করে দিলাম। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার দুই চোখেই টিউমারটির উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর ক্যামোথেরাপির সিদ্ধান্ত হয়। ক্যামোথেরাপির খরচ বহন করতে পরিবারটি সমর্থবান নয়। পরিবারটি আবারও আমার শরণাপন্ন হলে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করি এবং শিশুটির চিকিৎসা চলছে, যদিও তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

বাংলাদেশে চিকিৎসাসংক্রান্ত খরচে ওষুধ কতটুকু বোঝা হয়ে আছে সেই ব্যাপারে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের সিংহভাগ ৭৩% নিজ পকেট থেকে বহন করতে হয়। সেই খরচের সিংহভাগ (৬১-৮৭ শতাংশ) আবার ব্যয় হয় ওষুধ ক্রয় বাবদ। কনসাল্টেশন ফি বাবদ খরচ হয় ৮-১৫ শতাংশ। ইনভেস্টিগেশন বাবদ খরচ হয় ১২-১৫ শতাংশ। ওষুধের খরচের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগসংক্রান্ত চিকিৎসায়।

ওষুধের খরচের বিষয়টি একটি বহুমাত্রিক জটিলতা। অনেক ওষুধ আছে যেগুলো অনেক আগে থেকেই চালু আছে। এগুলো এখনও ভালো কাজ করে অথচ দাম কম। ওষুধের পেটেন্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে অরিজিনাল কোম্পানিকে তখন পেটেন্ট বাবদ আর রয়েলিটি দিতে হয় না। ফলে দাম কমে আসে। বাইরে এগুলোকে বলা হয় জেনেরিক মেডিসিন। আর যেগুলো নতুন আবিষ্কৃত এবং পেটেন্ট বহাল আছে বা রয়েলিটি দিতে হয় তার দাম সব সময় বেশি। এগুলোকে বলা হয় ব্রেন্ড প্রডাক্ট। ওষুধ কোম্পানিগুলো সব সময় চিকিৎসকদের উৎসাহিত করে ব্রেন্ড বা দামি ওষুধ প্রেসক্রাইভ করার জন্য। ফলে রোগীর চিকিৎসা খরচ বেড়ে যায়। এ ছাড়া ওষুধের অতিমূল্যায়নও একটি কারণ। সরকারের নিয়ন্ত্রণের অসাধুতা ও শৈথিলতার সুযোগে কোম্পানিগুলো অধিকতর মোনাফা সংযোজন করে তবে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। অতিমূল্যায়িত ওষুধ খরচ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। বিশেষ করে লাইফসেভিং ওষুধ এবং জরুরি চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের বেলায় এটি বেশি প্রযোজ্য। ওষুধ কোম্পানিগুলো ঔষধ প্রশাসন ও বিশেষজ্ঞদের ওপর বিভিন্ন অনৈতিক পন্থায় প্রভাব বিস্তার করে এ কাজটি করতে সমর্থ হয়। অতিমূল্যায়ন বাদেও কিছু ওষুধ আছে স্বাভাবিক মূল্য পরিশোধও সাধারণের জন্য কঠিন। অনেকেই সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হন বা অপারগতার জন্য চিকিৎসা থেকে ছিটকে পড়েন। আরও একটি কারণ উল্লেখ না করলেই নয়, সেটি হলো অপ্রয়োজনীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করা। প্রয়োজনীয় এক বা একাধিক নির্ধারিত ওষুধ প্রেসক্রাইব করার সঙ্গে অনেক চিকিসক এক বা একাধিক আবশ্যক নয় এমন ওষুধ প্রেসক্রিপশনে জুড়ে দিয়ে থাকেন। অনেক চিকিৎসক অনেক সময় প্রেসক্রাইব করার সময় রোগীর আর্থিক বিষয়টিকে আমলে নিতে আগ্রহ দেখান না। এই অনাগ্রহের পেছনে অনেক সময় কোম্পানির অনৈতিক প্রভাব কাজ করে থাকে।

ওষুধ ক্রয়বাবদ খরচের এই পাহাড়সম বোঝা যা রোগীকে পিষ্ট করে ফেলছে তার দায় কে নেবে? এর থেকে মুক্তিই বা কীভাবে মিলবে? ওষুধ কোম্পানির অতিমুনাফা, চিকিৎসকদের নৈতিক স্খলন, ঔষধ প্রশাসনের নৈতিকতা বা সক্ষমতার ঘাটতি এমন অনেক কিছুর ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া যায়। তবে সবশেষে সব দায় বর্তাবে সরকারের ওপর। সরকার এর দায় কোনোমতেই এড়াতে পারে না। সরকার কী করতে পারে? সরকার প্রশাসনের সক্ষমতা ও নৈতিকতার জায়গায় স্বচ্ছতা আনয়নের চেষ্টা করতে পারে। চিকিৎসক যেন নৈতিকতার জায়গা থেকে স্বাস্থসেবা দিতে বাধ্য হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। এতে ওষুধ কিছুটা সাশ্রয়ী হবে। তবে সব ওষুধ সুলভমূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে উল্লেখযোগ্যভাবে এবং ওষুধে ভর্তুকি দিতে হবে। ওষুধের যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি, ওষুধ প্রস্তুত ও বাজারজাতকরণে ভ্যাট-ট্যাক্স ইত্যাদি কমাতে হবে। দরিদ্র দেশের প্রত্যাশা ও সামর্থ্যরে মধ্যে বিস্তর ফারাক। সরকার যদি প্রয়োজনীয় বাজেট সংকুলান করতে না পারে তবে ন্যূনতম জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে একটি বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ওষুধ বিতরণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাজেট বরাদ্দ হওয়া উচিত জিডিপির ৫ শতাংশ। আমাদের বাজেটে এক শতাংশের ঘর অতিক্রম করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে অর্থ বরাদ্দ ব্যতিরেকে জনগণের চিকিৎসা তথা ওষুধের খরচ কমানোর কোনো চেষ্টাই ফলপ্রসূ হবে না। ন্যূনতম জীবনরক্ষাকারী ওষুধ বিতরণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে খুব বড় বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন হবে না। সরকার যেহেতু হাসপাতালভিত্তিক একটি ওষুধ বিতরণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের চিন্তাভাবনা করছে, সেখানে বিষয়টি মাথায় রাখতে পারে। মানবিক কারণে সরকারের উচিত বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমলে নেওয়া।


ডা. মো. ছায়েদুল হক : চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও সার্জন

এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক