গণতন্ত্র ও কবিতা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
১৫ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
গণতন্ত্র ও কবিতা

সবাই যেমন কবি নন, সব কবিও তেমনি গণতন্ত্রের পক্ষে নন। বিপক্ষেও কেউ কেউ ছিলেন বৈকি। অত্যন্ত অকাব্যিকভাবেই ছিলেন। চামচার রূপ ধারণ করে। তারা কে কত বড় কবি ছিলেন সে প্রশ্ন এখানে বিবেচ্য নয়, তারা যে একজন স্বৈরশাসকের বড় বড় তারকা ও উমেদার ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শাসকদের জন্য সব আদালতের বড় আদালত ইতিহাসের বিচারালয়। সেখানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো কমতি থাকবে না। একটি সূক্ষ্ম অতি বেশি গভীর অভিযোগ হবে ওই সরকারের সাংস্কৃতিক নিপীড়নের। এরশাদ একাধারে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেছেন এবং কবিতা লিখেছেন। তার কবিতা লেখার তৎপরতায় মানুষ খুবই অতিষ্ঠ ছিল, এটা সত্য।

তা তিনি তো একজন ভালো অভিনেতাও ছিলেন। কিন্তু কই তা নিয়ে তো কেউ আপত্তি করেননি; তবে তফাত আছে। তিনি নিজেকে কোনোদিন অভিনেতা বলে দাবি করেননি; কিন্তু কবি বলে দাবি করেছেন। কেবল দাবি করে যদি ক্ষান্ত হতেন, তবু সহ্য করা যেত। কিন্তু তিনি তো ওখানে ক্ষান্ত হননি। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করেছেন নিজের কবিখ্যাতি প্রতিষ্ঠার কাজে। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তার কবিতা ছাপা হয়েছে এবং তার লেখার ওপর ‘বিখ্যাত’ সমালোচকদের কেউ কেউ সেই স্টাইলে প্রবন্ধ লিখেছেন যে স্টাইলে তারা রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে লিখে থাকেন।

আপনি কবিতা লিখবেন লিখুন, আমার স্বাধীনতা থাকবে সেই কবিতা ফেলে দেওয়ার, তাকে নিয়ে হাস্যকৌতুক করার (প্রয়োজনবোধে); কিন্তু আপনি জোর করে আপনার কবিতা শোনাবেন, কেবল শোনাবেন না, বাধ্য করবেন আপনাকে কবি বলে স্বীকার করে নিতে, এটা বাড়াবাড়িÑ লোকে মনে করেছে। বাঙালি চিরকালই কবিতাপ্রেমিক। আর সেজন্যই ওই বিশেষ ক্ষেত্রে রোমশ উৎপাত তার জন্য বিশেষভাবে অসহ্য। এরশাদ সাহেবের ধিকৃত হওয়ার পেছনে তার কাব্যযশ স্পৃহা কম দায়ী নয়। তার কবি-বন্ধুরা মোটেই তার উপকার করেননি, বরং স্থায়ী অপকার করে গেছেন। ইতিহাসে, তিনি আরও অনেক কিছুর সঙ্গে কবিতার ওপর হস্তক্ষেপকারী হিসেবেও পরিচিত হবেন। সেবার তার ওই কবি-বন্ধুরা যে একটি আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব করে ইংল্যান্ড থেকে একজন রাজকবিকে এনে হাজির করেছিলেন তাতেও তার কাব্যপ্রীতি প্রমাণিত হয়নি। প্রমাণিত হয়েছে বরং স্বৈরশাসকের মনোভাব। যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন লোকে ভেবেছে, বিষণ্নভাবে।

গণতন্ত্র কবিতা চায়, কবিতাও গণতন্ত্র চায়। দুজনেরই দুজনকে প্রয়োজন। গণতন্ত্রের তো অনেক মিত্র চাই, কেননা গণতন্ত্র বলতে তো কেবল নির্বাচন বোঝায় না। এবং নির্বাচিত সরকারও যে স্বৈরাচারী হতে পারে তাও ঠিক, আর তারা যদি ব্যর্থ হয় তবে সেই সুযোগে অনির্বাচিতরা এসে যেতে পারে ক্ষমতায়। আসলে প্রয়োজন একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যার সৃষ্টিতে কবিতার একটা ভূমিকা থাকবে, অবশ্যই। কবিতাও গণতন্ত্র চায়। হ্যাঁ, অতীতে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও উৎকৃষ্ট কবিতা লেখা হয়েছে। সেটা ঠিক। কিন্তু অতীতে কখনও রাষ্ট্র এমনভাবে সর্বত্রগামী ও সর্বত্র হস্তক্ষেপকারী ছিল না, আজ যেমন হয়েছে। স্বৈরাচারের সবচেয়ে বড় অন্যায় মানুষকে সে সন্ত্রস্ত রাখে এবং সন্ত্রস্ত অবস্থায় অন্য কাজ যেমন-তেমন কবিতা লেখা খুবই কঠিন। জাতীয় কবিতা উৎসবের মঞ্চে বসে শিল্পী কামরুল হাসান তার জীবনের শেষ ছবিটি আঁকেন, নাম দিয়েছিলেন ‘বিশ্ব বেহায়া’ সেই ছবির যিনি বিষয়বস্তু তার পতন ঘটেছে। সেটা যে খুবই আশার কথা তা সবাই জানেন; কিন্তু ওই ব্যক্তি যে ব্যবস্থার প্রতিনিধি তার কি পতন ঘটেছে, নাকি একটি ব্যক্তি ও তার কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ সরে গেছেন, বাকি সবকিছুই আগের মতোই আছে? আগের মতো আছে বলেই আমাদের ধারণা; কেননা পরিবর্তন তো তেমন কিছু দেখছি না। হ্যাঁ, নির্বাচন হলে। একদল লোক জনপ্রতিনিধি হয়ে আসবেন সেটাও ঠিক। কিন্তু এরা কারা? কারা আসবেন? যিনিই আসুন টাকা খরচ করেই আসবেন। বাস্তবে অধিকাংশ প্রার্থী কমপক্ষে অজস্র অর্থ খরচ করবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই টাকা তারা কোথায় পাবেন? বর্তমান আমলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধনী হওয়ার কি কোনো উপায় আছে? ধনী ও কার্যত অস্থানীয় ব্যক্তিরাই নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তা তিনি যে মার্কা নিয়েই আসুন, যে আওয়াজ দিয়েই আসুন। এসে তার প্রথম কর্তব্য হবে সুদে-আসলে খরচের টাকা তুলে ফেলা। দ্রুত তুলবেন এবং সে টাকা জনগণকেই দিতে হবে, সন্দেহ কী। হালের মস্তানরা যে তৎপরতা দেখায় তাতে যা প্রমাণ হওয়ার প্রমাণ তাই হবে। কয়েকজন লোক গেছে সরে, তাও আপাতত। বেহায়া ব্যবস্থা বদলায়নি। কেউ কেউ নাকি আবার নির্বাচিত হয়ে আসার অপেক্ষায়। আইনসভায়।

আমরা একটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছি। এই ব্যবস্থা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে পরস্পর থেকে। লোকে তখন সাঁকো না খুঁজে সিঁড়ি খোঁজে। সাঁকো মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধন গড়ে তোলে, সিঁড়ি মানুষকে ওপরের দিকে নিয়ে যায়, ক্রমাগত উন্নতি ভালো, কিন্তু যে উন্নতি কেবল বৈষয়িক তাতে যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়, সেটি সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর। সবাই সিঁড়ি খুঁজে পায় না, কিন্তু সবাই সিঁড়ি খোঁজে। এই যে বিচ্ছিন্নতা মানুষে মানুষে, কবিতা পারে তাকে রোধ করতে। কিন্তু কবি যেখানে নিজেও বিচ্ছিন্ন, কবিতা সেখানে মূল্য পায় না, সেখানে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন।

আমাদের দেশে কবিতার সঙ্গে শত্রুতা করা হয় আরও একটি নগ্ন উপায়ে, সেটি হচ্ছে অধিকাংশ মানুষকে দরিদ্র, অশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ রেখে। কবিতা পাঠক চায়। কিন্তু পাঠক সে পাবে কোথায়? অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত, শিক্ষিতরাও বাঁচার সংগ্রামে বিধ্বস্ত, এখানে কাব্যপাঠের সুযোগ স্বভাবতই সীমিত।

কবিতাকে তাই লড়তেই হয় বেহায়া স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এ লড়াই যে অতি প্রকাশ্যভাবে হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, সূক্ষ্মভাবেও হতে পারে, সূক্ষ্ম লড়াইটাই গভীর আসলে এবং অধিক ফলপ্রসূ। কেননা কবিতার প্রথম অঙ্গীকার হবে শিল্পের কাছে। কবিতাকে অবশ্যই কবিতা হতে হবে, যেমন মানুষকে মানুষ হতে হবে। কিন্তু মানুষ যেমন মানুষ হয় না কেবল তার চেহারার কারণে, ভেতরের মনুষ্যত্বও দরকার হয়, কবিতাও তেমনি কবিতা হবে কেবল চেহারায় নয়, ভেতরের গুণেও। সেই গুণের মধ্যে রয়েছে কবির অনুভব ও অভিজ্ঞতা। ওই যে বলা হয়েছে কথা যে, পৃথিবীতে কোনো কবিই অদ্যাবধি বড় হননি, যিনি দার্শনিক নন। নান্দনিকতা দার্শনিকতাকে বাদ দিয়ে নয়, সঙ্গে নিয়ে। উভয়ে মিলেমিশে একত্র হয়ে, একটি অভিন্ন সত্তা গড়ে তুলে। আমাদের দেশে নজরুল ইসলাম ও সুকান্ত ভট্টাচার্য গণতন্ত্রের পক্ষে স্পষ্টভাবে বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ অতটা উঁচু গলায় বলেননি, কিন্তু তার লেখাও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পক্ষেই, অন্যভাবে, ভিন্ন সুরে। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রকাশ্যে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বলেছেন, তখনই যে কেবল তিনি স্বৈরাচারবিরোধী ছিলেন তা নয়। পরাধীন দেশে তার সংস্কৃতিচর্চা নিজেই ছিল স্বৈরাচারবিরোধী একটি শান্ত, কিন্তু আপসহীন অভ্যুত্থান। আজকের কবি যখন গণতন্ত্রের পক্ষে এবং স্বৈরাচারী বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপক্ষে বলবেন, তখন এঁদের ঐতিহ্যকে নিজের মধ্যে ধারণ করে নতুনভাবে বলবেন, মৌলিক উপায়ে লিখবেন।

গণতন্ত্রের পক্ষে অতি দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন আমেরিকার কবি ওয়ান্ট হুইটম্যান, ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ১৮৫৫-তে তিনি যখন লিভস অব গ্রাস্থ নামে কাব্য সংকলন প্রকাশ করেন তখন তাতে কবিতা ছিল ১২টি, পরবর্তী প্রত্যেকটি সংস্করণে কবিতার সংখ্যা বেড়েছে এবং প্রত্যেকটি কবিতায় রয়েছে গর্ব ও দুঃসাহসের সঙ্গে গণতন্ত্রের পক্ষ সমর্থন। কিন্তু তিনি স্বৈরাচারের বিপক্ষেই বলছিলেন আসলে, গণতন্ত্রের পক্ষে বলতে গিয়ে; নইলে তার গণতন্ত্রী কবিতা প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রী হতো না। আমেরিকায় যখন নতুন একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, হুইটম্যান চেয়েছিলেন এই নতুন সংস্কৃতিতে পুরাতন ঐতিহ্যের কুসংস্কার ও অগণতান্ত্রিক প্রবণতাগুলোর যাতে স্থান না হয়। যেন নতুন আবাসে নতুন একটি মনোভাব গড়ে ওঠে, মুক্তি ও গণতন্ত্রের পক্ষে। তার কবিতা আজও স্মরণীয়, কেননা একটি বিশিষ্ট দার্শনিকতার সঙ্গে সেখানে কল্পনা ও বৈদগ্ধের নান্দনিক গুণের সমন্বয় ঘটেছিল। হুইটম্যান দ্বিতীয়বার আসবেন না; আমেরিকায় নয়, অন্য দেশেও নয়। তাছাড়া আজ যদি তিনি আমেরিকায় আসেনও তাহলে হয় পাগল বলে উপেক্ষিত, নয়তো বেয়াদব বলে অবরুদ্ধ হবেন। পুঁজিবাদ সেখানে এমনভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওই পুঁজিবাদ এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। একাধারে সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে।

কিন্তু গণতন্ত্রের লড়াই তো চলবে। এ লড়াইয়ে শিল্পী কামরুল হাসান থাকবেন, তেমনি শ্রমজীবী নূর হোসেনও থাকবেন, কবি থাকবেন, থাকবে কৃষকও; বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে মিলন ঘটবে জনগণের এবং সেই মিলনই এগিয়ে নিয়ে যাবে সংস্কৃতিকে নব-নব বিজয়ের পথে। বিশ্ব বেহায়াদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। সেই সঙ্গে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীরাও থাকবেন, থাকবেন জনমত জরিপকারীরাও। জনমত যাচাইয়ের দ্বারা আমরা এগোতে পারব না। জনমত সৃষ্টি করেই এগোতে হবে। গণতন্ত্রের সব মিত্র প্রকৃত মিত্র নন, নিজেরা তারা যাই মনে করুন না কেন।


সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়