পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন নিশ্চিতের সময় এখনই
গবেষণা, শিক্ষাদান এবং জনসেবা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যগত ভূমিকা। তবে অংশীজনরা এসব উচ্চশিক্ষা এবং ঐতিহ্যগত ভূমিকার পাশাপাশি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত সামাজিক প্রভাব-প্রবণতা আশা করে। এসব ভূমিকা অবশ্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে জবাবদিহিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে হতে হবে। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নতুন ধাঁচের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সৃষ্টি, ব্যক্তিগত ব্যবস্থা বৃদ্ধি এবং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাডেমিক সহায়তা সম্প্রসারণের দিকে পরিচালিত করেছে।
এ ছাড়াও শিক্ষাদানের নতুন নতুন পদ্ধতি আবির্ভূত হচ্ছে। এসব পদ্ধতি ই-লার্নিং এবং ডিস্ট্যান্ট লার্নিংসহ অন্যান্য সেবা প্রদানের পথকে সহজ করে দিচ্ছে। একইভাবে শিক্ষার্থীরা বহুমুখী দক্ষতায় বিকশিত হচ্ছে। সবচেয়ে কার্যকর ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন বর্তমানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উচ্চশিক্ষার সংস্কারে সাম্প্রতিক আন্দোলন ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যকর ও সুষ্ঠু শাসনের মাধ্যমেই মানসম্পন্ন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এই সংস্কৃতিই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষাদান এবং শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি অংশীজনদের অংশগ্রহণকে ত্বরান্বিত করে।
একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সফল হতে হলে অবশ্যই সেখানে দায়িত্বশীল এবং দক্ষ শাসনব্যবস্থা থাকতে হবে। সুশাসন বিকাশের জন্য এমন শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন যিনি বা যারা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে সহযোগিতা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া নিশ্চিত করতে পারবেন। তার কাজ হবে প্রতিটি ব্যক্তির নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সবার সামনে এনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা। লক্ষ রাখতে হবে, এই পরিবেশে যেন দলগত কাজ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এই শক্তিশালী নেতৃত্ব দ্বারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে। স্বভাবতই, ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একজন দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তাকে সব সময় সামনে রাখে, সুস্পষ্ট সমস্যা খুঁজে তার সমাধানে মনোনিবেশ করে এবং এর জন্য সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত থাকে।
গতানুগতিক শাসনকাঠামো দীর্ঘকাল ধরে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে আমরা একবিংশ শতাব্দীর জটিলতা নিয়ে আলোচনা করছি। এখন গতানুগতিক এসব শাসনকাঠামো নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, যার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। কঠোর শাসনকাঠামো, জবাবদিহির অভাব, সীমিত মান নির্ধারণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, খ-িত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্থবির নেতৃত্বকাঠামো, অপর্যাপ্ত অংশীজন-সংশ্লিষ্টতা, পরিবর্তনের পথে বাধা, বাজারব্যবস্থা গতিশীলতার ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত সাড়া এবং সঠিক ভবিষ্যদ্বাণীর অভাব বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন শিক্ষাগত সুশাসন অর্জনের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরও উপযুক্ত, সময়োপযোগী এবং দক্ষ শাসনকাঠামো তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রতি নিযুক্ত প্রশাসকদের (উপাচার্য) উপরোক্ত সমস্যাগুলোকে গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে তা মোকাবিলার চেষ্টা করা উচিত। গৃহীত পদক্ষেপগুলোতে যেন সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে এসব প্রাতিষ্ঠানিক নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জড়িত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মিত তাদের গৃহীত পদ্ধতির মূল্যায়ন এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংশোধন করবে। অংশীজনদের কার্যক্রমকে মূলভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে এই মূল্যায়ন করতে হবে। এই পুনরাবৃত্ত প্রক্রিয়ায় যেন বিশ্ববিদ্যালয়টি সর্বদা শিক্ষার পরিবর্তনের প্রতি নমনীয় এবং সংবেদনশীল হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক চাহিদার প্রতি নজর রেখে বিশ^ব্যাপী দক্ষতা এবং গবেষণা উন্নয়নের জন্য পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজাতে হবে। এই পাঠ্যক্রম তৈরির সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় চাহিদা বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সফলভাবে শিক্ষার্থীদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হলে অংশীজনদের থেকে একটি ব্যাপক ও বোধগম্য পদ্ধতি এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যাই হোক, শিক্ষা একটি সেবা এবং শিক্ষার্থীদের মতামত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তা স্বীকার করেই শাসনকাঠামো পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও ভাবমূর্তি এই পরিষেবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সম্মিলিত নেতৃত্ব প্রদর্শনের সময় এসেছে। একাডেমিক মান ও কৌশল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করা ব্যক্তিদের উপযুক্ত একাডেমিক কাঠামোর মাধ্যমে সর্বোত্তম শিক্ষা, গবেষণা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে উপাচার্যকে নেতৃত্ব দিতে হবে। ক্যাম্পাসের সব কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি একাডেমিক প্রোগ্রামের কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক দিকগুলো দেখভাল করা উপাচার্যের কাজের আওতার মধ্যে পড়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি এবং একটি সফল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কাজের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিতের জন্য অবশ্যই দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞ অধ্যাপক নিয়োগ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় যেন বিশ্ব ব্যাপী স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য উপাচার্যকে কৌশলগত পরিকল্পনার উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। গবেষণা প্রকল্প এবং পিপিপি উন্নয়নের জন্য উপাচার্যকে অবশ্যই সরকার এবং অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে অংশীদারত্বকে উৎসাহিত করতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়ের সুনাম অর্জনে শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদ, প্রতিষ্ঠান, সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা এবং এসব প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা আবশ্যক। বলা বাহুল্য, বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসকদের সামনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অর্জন এবং খ্যাতি প্রচার করতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বার্থে বিভিন্ন নামি-দামি প্রতিষ্ঠান, সরকার এবং প্রাক্তন ছাত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং বিশ^বিদ্যালয় উন্নয়নে তাদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো প্রয়োজন। এতে সব অংশীজন আগ্রহের সঙ্গে বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়নে সহযোগী হবেন।
আমি বিশ^াস করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ প্রশাসন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মান বৃদ্ধির জন্য নতুন ও সৃজনশীল পন্থা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে এবং ধাপে ধাপে প্রকৃত শিক্ষাব্যবস্থা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগুলো সফলভাবে প্রয়োগ করবে। শিক্ষা শাসন অর্জনের জন্য উপাচার্যকে অবশ্যই বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা, নৈতিক অবস্থান এবং প্রশাসনিক দক্ষতার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য নেতৃত্বের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে। তবেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন হবে এবং তা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!