ভুয়া মামলার হয়রানি লাঘব করতে হবে
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ফরেন সার্ভিস ট্রেনিং একাডেমিতে গত ২৯ জুন এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, ভুয়া মামলা কিংবা মামলার ভুয়া আসামিরা এখন থেকে প্রাথমিক তদন্তের পরই সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বে রেহাই পাবেন। নতুন বিধানে বলা হয়েছে কমিশনার, এসপি বা এসপি পদমর্যাদার কোনো পুলিশ কর্মকর্তা তার নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো মামলার বিষয়ে যদি মনে করেন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন চাওয়া যৌক্তিক তা হলে তিনি তা চাইতে পারবেন। প্রতিবেদন প্রস্তুত হলে তখন তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেবেন। ম্যাজিস্ট্রেট যদি দেখেন মামলায় কোনো আসামিকে বিনা অপরাধে জড়ানো হয়েছে, যার বিরুদ্ধে যথাযথ কোনো প্রমাণ নেই তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুক্তি দিতে পারবেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি, আমাদের পুলিশ প্রশাসন ও আদালত প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করবে। যেসব মামলায় গ্রেপ্তার বা মামলা-বাণিজ্য হচ্ছে, তাদের আদালত প্রিট্রায়াল স্টেজে মামলা থেকে মুক্তি দিতে পারবেন।’ তবে মামলার তদন্ত চলতে থাকবে পুলিশ যদি পরবর্তী সময়ে দেখে, আগে যাদের মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে পরে প্রকৃত প্রমাণ পাওয়া গেছে, তখন তাদের নাম আবার মামলায় যুক্ত করতে পারবেন। উপদেষ্টা পরিষদের ২৯ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে ফৌজদারি কার্যবিধির একটি সংশোধনী এভাবে অনুমোদন করা হয়েছে (সূত্র : একটি জাতীয় দৈনিক-৩০ জুন, ২০২৫)। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে ভুয়া মামলা বা গায়েবি মামলার উৎপত্তি তো কোনো আইন সৃজন করে হয়নি। বিদ্যমান আইনের অপব্যবহার করে সেটা করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমেই তো সেটাকে নির্মূল করা যায়। মৌখিক নির্দেশে যে অন্যায্য কাজের সৃষ্টি, মৌখিক নির্দেশেই সে অন্যায্য কাজ বন্ধ করা যায়। সেজন্য আইন প্রণয়ন করার কোনো আবশ্যকতা নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশ থেকে ভুয়া বা গায়েবি মামলার উৎপত্তি হয়েছে বিধায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণলয়ের মৌখিক নির্দেশেই সেটা বন্ধ হওয়া উচিত সর্বোচ্চ একটা পরিপত্র জারি করে সেটা বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। পরিপত্রে ভুয়া মামলা বা গায়েবি মামলা দায়ের বা সৃজনের জন্য দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ থাকতে পারে।
সে পথে না হেঁটে ফৌজদারি কার্যবিধিতে সংশোধনী এনে ভুয়া বা গায়েবি মামলা থেকে প্রতিকার দিতে চাওয়ায় যে অসুবিধা সাধারণ জনগণকে মোকাবিলা করতে হবে সেটা নিম্নরূপ
১. ভুয়া বা গায়েবি মামলার বিষয়টাকে আইনি তথা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলো। তাতে ফৌজদারি কার্যবিধির মান ক্ষুণ্ন হয়েছে কারণ ১৮৯৮ সালে রচিত ফৌজদারি কার্যবিধির একটা বিশ্বমান রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির যে কোনো ধরনের সংশোধনীতে সেই মান রক্ষার বিষয়টা গুরুত্ব পাওয়া আবশ্যক। এই সংশোধনীর ফলে এখন কেউ পুলিশকে ভুয়া বা গায়েবি মামলার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলে জবাবে পুলিশ জানাবে, ‘আমরা সেটা দিতে পারি আর আপনি আইনি বিধান মেনে প্রতিকার চাইতে পারেন।’ এতে করে ভুয়া বা গায়েবি মামলার সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২. ভুয়া মামলার হাত থেকে বাঁচার জন্য পুলিশ সুপারের কাছে বিভিন্ন মামলার আসামিদের পক্ষ থেকে তদবির বা ছোটাছুটি বেড়ে যাবে। তাতে পুলিশ সুপারকে অতিরিক্ত ঝামেলা মোকাবিলা করতে হবে। প্রকৃত আসামিরাও সে সুযোগ হাতছাড়া করবে না। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব হবে না।
৩. ভুয়া মামলার হাত থেকে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে হাকিমের আদেশে রেহাই মেলার পর পুনরায় তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক তাকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করতে পারার যে বিধান রাখা হয়েছে সেটা বিধিসম্মত হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিকে চার্জশিটে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা আপিল আদালতের অনুমতি লাগার কথা। সেই বিধান না রাখায় পুলিশের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি আরও বেড়ে যাবে। বিষয়টা কেমন পুলিশ চাইলে ভুয়া মামলায় জড়াতে পারে, প্রাথমিক তদন্তে অব্যাহতির জন্য সুপারিশ করতে পারে আবার ইচ্ছা করলে তাকে চার্জশিটভুক্ত আসামি বানাতে পারে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এখন দেখা যাক প্রচলিত আইনে ভুয়া বা গায়েবি মামলার আসামি বা আসামিরা কী কী সুবিধা পেতে পারেন-
ক. এফআরআই কিংবা চার্জশিটে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে হাকিম তার জামিন মঞ্জুর করতে পারেন- এটা হচ্ছে প্রাথমিক রিলিফ।
খ. ফৌজদারি কার্যবিধি ২৪১/এ ধারা প্রয়োগ করে চার্জশিটভুক্ত আসামিকেও ডিসচার্জ করা যায়। যে কোনো মামলায় আসামি বা আসামিদের বিরুদ্ধে ফর্মাল বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করার নিমিত্ত অভিযোগ গঠনের জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সে তারিখে এফআইআর, চার্জশিট অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পরীক্ষাক্রমে, দুই পক্ষের নিয়োজিত আইনজীবীর বক্তব্য শুনে হয়তো অভিযোগ গঠিত হবে নতুবা মামলা ভিত্তিহীন বলে আসামি বা আসামিদের ডিসচার্জ করা হবে। এটা একজন হাকিমের দেবতার ঐশ্বরিক ক্ষমতাতুল্য অসীম ক্ষমতা। অথচ হাকিমরা এই ক্ষমতা খুব একটা প্রয়োগ করতে আগ্রহী নন। আসামিপক্ষের নিয়োজিত আইনজীবীও প্রফেশনাল কারণে তার মক্কেলদের এই জাতীয় সুযোগ পাইয়ে দিতে শতভাগ অনিচ্ছুক। আসামিপক্ষের আইনজীবী ফৌকাবি ২৪১/এ ধারায় আসামিদের ডিসচার্জের পক্ষে বক্তব্য না রাখলেও হাকিম ইচ্ছা করলে রেকর্ডপত্র পরীক্ষাক্রমে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন মনে করলে আসামি বা আসামিদের ডিসচার্জ করার আদেশ দিতে পারেন। আমি ২০০১ সালে নেত্রকোনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে ফৌকাবি ২৪১/এ ধারার অধীন হাকিমকে প্রদত্ত ক্ষমতা পুরোমাত্রায় প্রয়োগ করে মাত্র ৬-৭ মাসের কার্যকালে ৭৫০ মামলাকে কমিয়ে ২৭০-এ নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম।
গ. পুলিশ সুপার এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপাররা তো নিয়মিত তাদের অধীনস্থ থানাগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শন করে থাকেন। তারা তো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ না করার জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বাধ্য করতে পারেন। তা ছাড়া জেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সভায়ও বিষয়টা এজেন্ডাভুক্ত করে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও এ বিষয়ে তাদের ভূমিকা রাখতে পারেন। কোনো পুলিশ সুপার যদি ঘোষণা করতে পারেন তার জেলায় কোনো থানায় কোনো ভুয়া বা গায়েবি মামলা দায়ের করা যাবে না তা হলে সে জেলাকে ভুয়া বা গায়েবি মামলামুক্ত জেলা ঘোষণা করা অত্যন্ত সহজ একটা বিষয়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ঘ. সর্বোপরি আমলি আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটও এফআইআর দেখেই ভুয়া বা গায়েবি মামলার বিষয়টি আঁচ বা অনুমান করতে পারবেন এবং স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এরূপ আদেশ দিতে পারেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই তাদের একটি তালিকা এক সপ্তাহের মধ্যে আদালতে পেশ করার জন্য, তাদের নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য এবং তাদের কোনোরূপ হয়রানি না করার জন্য। ভুয়া মামলার হয়রানি লাঘবে এটা হতে পারে সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ।
আমাদের দেশে বেঠিক কোনো বিষয় সরকারি আদেশে একবার চালু হয়ে গেলে সেটাতে দ্রুত স্বার্থান্বেষী পক্ষের সৃষ্টি হয়ে যায় যা চিরস্থায়ী রূপ ধারণ করে ফেলে। উপর্যুক্ত পর্যবেক্ষণের আলোকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখার অবকাশ রয়েছে।
এ টি এম মোস্তফা কামাল : অর্থনীতিবিদ-আইনের বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!