প্রযুক্তি ও গবেষণায় কৃষির উন্নয়ন

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
১২ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
প্রযুক্তি ও গবেষণায় কৃষির উন্নয়ন

১৯৩৮ সালে দি বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অঞ্চলের কৃষিতে অবদান রেখে চলেছে ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপ পাওয়া শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ এই পথযাত্রায় বাংলাদেশের কৃষিতে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান রাখা নানা উদ্ভাবনের মধ্যে থেকে পাঁচটি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন শাহেদ মাহমুদ

প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার এসএইউ কিনোয়া ১

সুপার ফুড হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার কিনোয়া। দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো অভিযোজনক্ষম করে তুলেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস। দীর্ঘদিন গবেষণার পর বাংলাদেশের ক্রপিং প্যাটার্নের সঙ্গে সংযোজন উপযোগী করে কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। জাতীয় বীজ বোর্ড (এনএসবি) অনিয়ন্ত্রিত ফসলের জাত নিবন্ধনের আওতায় উদ্ভাবিত এ জাতটি নিবন্ধন দিয়েছে। সাউ কিনোয়া-১ নামে নতুন এ জাতটি নিবন্ধিত হয়। জাতটির নিবন্ধ নম্বর ০৫(৪৬)-০১/২০২০। কিনোয়ার বৈজ্ঞানিক নাম Chenopodium quinoa  ফসলটি Amaranthaceae  পরিবারভুক্ত একটি দানাশস্য। এতে রয়েছে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিংক, কপার, ফসফরাস, পটাসিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজ। রয়েছে সব ধরনের প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড। গ্লুটেন নামক উপাদান না থাকায় এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। কিনোয়া দানা পুষ্টি সমৃদ্ধতার কারণে ইতোমধ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা স্বীকৃতি দিয়েছে। খরা ও লবণাক্ত অঞ্চলসহ সারা দেশে রবি মৌসুমে এ ফসলটি চাষ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন গবেষক অধ্যাপক ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস। তিনি আরও জানান, সাউ কিনোয়া-১ খরা সহিষ্ণু এবং যে কোনো ফসল অপেক্ষা অধিকতর লবণাক্ত সহিষ্ণু। ধানসহ অন্যান্য ফসল যেখান ১০-১২ ডিএস/মি লবণাক্ত সহিষ্ণু হয়ে থাকে, সেখানে ‘সাউ কিনোয়া-১’ ৪০ডিএস/মি এও আশানুরূপ ফলন দিয়েছে।

উদ্ভাবিত এসএইউ স্মার্ট ড্রায়ার

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের শুঁটকি চাষিদের জন্য নিরাপদ শুঁটকি মাছ উৎপাদন, প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত শুঁটকি মাছের সমস্যাগুলো সমাধান ও রপ্তানি বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাসুদ রানা উদ্ভাবন করেছেন আইওটি বেইসড এসএইউ স্মার্ট ড্রায়ার। শুঁটকি মাছ রপ্তানির অন্যতম বাধা হলো দেশে উৎপাদিত শুঁটকি নিরাপদ নয়। ফলে বিপুল পরিমাণে শুঁটকি উৎপাদন হলেও রপ্তানি করা যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ শুঁটকি তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নেই কোনো আধুনিকায়িত টেকনোলজি এবং নির্দিষ্ট মান যাচাইকরণ। তবে উদ্ভাবিত ড্রায়ারটি দিয়ে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন করার মাধ্যমে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের শুঁটকির চাহিদা বাড়বে যা আমাদের বৈদশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হবে। উদ্ভাবিত যন্ত্রটিতে স্মার্ট টেকনোলজি ব্যবহার করে অটোমেশন করা হয়েছে। ফলে ড্রায়ারটি নিজের ড্রায়িং এনভায়ারমেন্ট নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। উদ্ভাবিত ড্রায়ারটিতে সোলার ব্যবহার করা হয়েছে, যেখান থেকে ব্যাটারিতে শক্তি সঞ্চিত হয় যা রাতের বেলা তাপ সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হয়। উদ্ভাবিত ড্রায়ারটি দিনের সূর্যের তাপ ব্যবহার করে মাছ শুকাবে, রাতের বেলা সোলার থেকে প্রাপ্ত শক্তির সহায়তায় হিটারের মাধ্যমে তাপ সৃষ্টি করবে, ফলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা মাছ থেকে পানি অপসারণ হবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ শুকানোর জন্য দিনের বেলা সময় পাওয়া যায় ৫-৭ ঘণ্টা। কিন্তু উদ্ভাবিত ড্রায়ারটিতে ২৪ ঘণ্টা মাছ শুকানো যাবে। ফলে মাছ শুকানোর সময় ৬০% কমে আসবে। তাই একই সময়ে দ্বিগুণ পরিমাণ শুঁটকি মাছ উৎপাদন করে দ্বিগুণ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। শুঁটকি তৈরির পাশাপাশি এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলমূল, সবজি ও ভেষজ উদ্ভিদ শুকিয়ে একদিকে যেমন খাদ্য অপচয় রোধ হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি গুণগত মানসম্পন্ন শুকনো পণ্য বাজারজাতকরণও করা যায়।

মৌমাছির কৃত্রিম প্রজনন

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো রানি মৌমাছি উৎপাদন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেনের নেতৃত্বে একদল গবেষক। ২০১৮ সালে উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি ব্যবহারে মধুর উৎপাদন দেড় থেকে দুই গুণ বৃদ্ধিসহ প্রজননজনিত বেশ কিছু সমস্যাও সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আশা করেন তারা। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় এ গবেষণায় রানি মৌমাছিকে প্রথমে অচেতন বা অনুভূতিহীন করা হয় এবং চলনে অক্ষম করে তোলা হয়। পরে সিরিঞ্জের মাধ্যমে তার যোনি গহ্বরে সংগ্রহকৃত ড্রোনের সিমেন বা শুক্রাণু প্রবেশ করানো হয়। এই ব্যবস্থায় রানি ও ড্রোন উৎপাদনই প্রধান উদ্দেশ্য। কৃত্রিম উপায়ে সারা বছরই রানি মৌমাছি উৎপাদন সম্ভব যা প্রাকৃতিক উপায়ে সম্ভব নয় বলে দাবি করে বিশিষ্ট মৌ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, একটি ভালো উর্বর রানি মৌমাছির সফলভাবে সারা বছর ডিম দেওয়ার জন্য গড়ে বারোটির মতো পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের রানি মৌমাছিগুলো দিন দিন ডিম দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে যা বিশ বছর আগে এমন ছিল না। এজন্য প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত মিলন বা কৃত্রিম প্রজনন। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদিত মৌমাছি ৪-৫ বছর পর্যন্ত ডিম দিতে সক্ষম। অত্যধিক মাত্রায় কৃষিজমিতে কীটনাশক প্রয়োগ, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব, প্রজননজনিত দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে রানি মৌমাছির প্রাকৃতিক মিলনে সফলতার হার দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে মধুর উৎপাদন বাড়বে এবং মৌচাষিরাও অধিক মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হবে।

তেলজাতীয় এসএইউ পেরিলা ১

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এইচএমএম তারিক হোসেনের তত্ত্বাবধানে ২০০৭ সাল থেকে ধারাবাহিক গবেষণার পর দেশে এর চাষাবাদের উপযোগী হয় পেরিলার জাতটি। ২০২০ সালে ‘সাউ পেরিলা-১’ নামে জাতটি নিবন্ধিত হয়। ফসলটি গোল্ডেন পেরিলা নামেও সুপরিচিত। বর্ষা মৌসুমে (খরিপ-২) বাংলাদেশে চাষযোগ্য একমাত্র অভিযোজিত তেলজাতীয় ফসল এটি। এর বাণিজ্যিক উৎপাদনের ফলে ভোজ্যতেলের আমদানি কমানো সম্ভব বলে আশা করছেন গবেষকরা। বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা বছরে ২৪ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর ১০ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে তেলজাতীয় ফসল চাষ হয়। উৎপাদিত বীজ দিয়ে ৪ লাখ ৯১ হাজার লাখ টন তেল উৎপাদন সম্ভব। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০২৪ সালে ক্রুড পাম তেল ও ক্রুড় সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার ১৭৬ টন। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সাড়ে ৩ লাখ টনেরও বেশি সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। প্রতি মাসে সয়াবিন তেলের চাহিদা ৮৭ হাজার টন। তবে দেশের সব তেলবীজ শস্যই রবি মৌসুমের হওয়ায় বোরো ধানের জমি তেল চাষের জন্য ব্যবহার করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই এত বিশাল উৎপাদন ঘাটতি কমানোর প্রধানতম উপায় খরিপ মৌসুমে তেলজাত বীজের চাষ করা। এই সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেই সফল হন ড. তারিক ও তার পিএইচডি ফেলো ড. কাইয়ুম মজুমদার। ড. তারিক হোসেন জানান, এই বীজ থেকে ৪০ শতাংশ তেল আহরণ করা যায়। প্রাপ্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের ৯১ শতাংশ অসম্পৃক্ত, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া মস্তিষ্ক ও ত্বকের জন্যও উপকারী। এ তেলে প্রাপ্ত আমিষের পরিমাণ ২৫ শতাংশ। পানি জমে থাকে না এমন উঁচু জমিতে খরিপ-২ মৌসুমে এ ফসলের চাষ করা হয়। ১৫ থেকে ২৫ জুলাইয়ের মাঝে বীজ বপন করে প্রয়োজনীয় চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করে হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ টন ফলন পাওয়া যায়। পরিচর্যার খরচও কম বলেছেন কৃষক ও গবেষকরা। বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদেশ থেকে আমদানি করা পেরিলা তেল দেশে লিটারপ্রতি দুই হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। ড. কাইয়ুম মজুমদার বলেন, আমরা জরিপ করে দেখেছি- আমনের আবাদযোগ্য জমি না কমিয়ে ১ লাখ হেক্টর জমিতে আমরা সাউ পেরিলার আবাদ করতে পারব। এতে কমে যাবে তেলের আমদানির পরিমাণ।

সরিষার নতুন জাত এসএইউ ক্যানোলা ১

দেশে রপ্তানিযোগ্য ভোজ্য সরিষা তেল উদ্ভাবন করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক জামিলুর রহমান। ক্যানোলা গ্রেডের সরিষার এই জাতটির নাম এসএইউ ক্যানোলা-১। ২০২৩ সালে নতুন নিবন্ধিত তার এই জাতটিতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ইরোসিক অ্যাসিডের পরিমাণ ১ শতাংশেরও নিচে। বাংলাদেশে ভোজ্যতেল সরিষায় ক্ষতিকর ইরুসিক অ্যাসিড (৪০-৫০ শতাংশ) থাকায় উন্নত দেশের বাজারে রপ্তানি করতে পারছে না বাংলাদেশ। তবে ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেখা গেছে, নতুন নিবন্ধিত এসএইউ ক্যানোলা-১ জাতটির ইরোসিক অ্যাসিডের পরিমাণ ০ দশমিক ৭ শতাংশ। পাশাপাশি জাতটিতে উচ্চমাত্রার ওমেগা-৯ (৫১%), ওমেগা-৬ (৩১%) এবং ওমেগা-৩ (৭%) থাকায় এটি অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর ও উপকারী বলেছেন গবেষকরা। ড. জামিলুর রহমান ২০১৮ সাল থেকে ক্রুসিফেরি পরিবারের ব্রাসিকা জুনসিয়া প্রজাতির ২৫টি জার্মপ্লাজম নিয়ে কাজ শুরু করেন। জুনসিয়া প্রজাতিটি টেট্রাপ্লয়েড। এ জাতের গাছগুলোর ভিগোরিটি, প্রতিকূলতা সহিষ্ণুতা ও জীবনকাল অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে গবেষক জামিল নতুন এই জাতটির ইনব্রিডিং এবং রিকারেন্ট সিলেকশন, সেলফিংয়ের মাধ্যমে অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখেই জীবনকাল ১০৫ দিনে নামিয়ে আনতে সক্ষম হন। ফলে রপ্তানিযোগ্যতার পাশাপাশি দেশের কৃষির শস্যবিন্যাসেও অধিকতর উপযোগিতার সৃষ্টি করেছে জাতটি।