পাঠাগার গড়া যাদের স্বপ্ন ছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৫ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
পাঠাগার গড়া যাদের স্বপ্ন ছিল

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘অতলস্পর্শ কালসমুদ্রের উপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া’ দেয় মানুষ। বই আমাদের মন ভালো রাখে, জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটায়, বিকশিত করে প্রতিভা, ধাবিত করে সত্য ও সুন্দরের মধ্যে। বই ও পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধ সৃষ্টি করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কজন বইপ্রেমীকে নিয়ে জানাচ্ছেন সিফাত রাব্বানী

নুরুজ্জামান শুভ

বই মানুষের পরম বন্ধু, দিনশেষে সবাই ছেড়ে চলে গেলেও বই আমাদের ছেড়ে যায় না। আর বইপ্রেমীদের বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক টিকেই থাকে। নুরুজ্জামান শুভ, এমনই একজন বইপ্রেমী। পড়ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনার্সে অধ্যয়নকালে খেয়াল করলেন তার ক্যাম্পাসে ব্যক্তি উদ্যোগে কোনো বইয়ের কার্যক্রম সেভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। তার মতো এমন অনেকেই আছেন যারা বই পড়তে চান কিন্তু ছাত্র অবস্থায় খুব বেশি বই কিনে বা হলে-মেসে রেখেও পড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি প্রত্যয়ী হয়েছিলেন এবং গড়ে তুললেন ‘শহীদ আজাদ-রুমী গ্রন্থাগার’। ২০২২-এর ২০ জানুয়ারি গ্রন্থাহারটি ছোট পরিসরে দেয়ালে একটি বক্স সংযুক্তের সঙ্গে চালু হলেও পরে বইয়ের সংখ্যা ব"দ্ধি পেলে এবং পাঠকদের ব্যাপক সাড়া দেখে টিএসসি থেকে তাদের রুম কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ করে দিয়েছে। এখন রয়েছে একটি আলমারিও। জাবির টিএসসির কমনরুমে এখন এর কার্যক্রম চলে। সপ্তাহে দুদিন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। শিক্ষার্থীরা এই দুদিনে বই সংগ্রহ করে এবং জমা দেন, এতে নেই কোনো মাসিক চাঁদা তবে সদস্য হতে দিতে হয় একশ টাকা। জাবির যে কোনো শিক্ষার্থী এই গ্রন্থাগার থেকে বই সংগ্রহ করতে পারেন। বই পড়া শেষে গ্রন্থাগারের ফেসবুক গ্রুপে অনেকে রিভিউ প্রকাশ করেন। আবার এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাই রিভিউ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি ব্যাচে তাদের প্রায় ১৫০ জন সক্রিয় পাঠক রয়েছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ বার বই গ্রন্থাগার থেকে সংগ্রহ করে পাঠকরা পড়েছেন। পাঠকরা ১টি বই ১ মাসের জন্য সংগ্রহ করে হলে কিংবা বাসায় নিয়ে গিয়ে পড়তে পারেন। মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, বিশ্বরাজনীতি, সভ্যতা, উপন্যাস, কবিতা, প্রহসন, প্রবন্ধ, অনুবাদ গ্রন্থসহ নানা ধরনের প্রায় ৪০০টি বই আছে। বেশিরভাগ বই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ উপহার দিয়েছেন। উদ্যোক্তা জানালেন বই পড়ার বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে তারা ব্যাপক সাড়া ফেলতে পেরেছেন। ক্যাম্পাসে এত সহজে বিনামূল্যে বই পড়ার সুযোগ আর না থাকায় শহীদ আজাদ-রুমী গ্রন্থাগার বইপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।

বইয়ের মূল কথা তুলে ধরেন ছবিতে

ফাতেমা কেয়া

বই নিয়ে রিভিউ হয়, ইদানীং বইয়ের ফটোগ্রাফি হয়, বই পড়া প্রতিযোগিতায় প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা হয়, তবে কখনো দেখেছেন বইয়ের থিম অনুযায়ী ফটোগ্রাফি করে একটি ছবির মধ্যেই বইয়ের মূলভাব তুলে ধরা যায়? সেটাই করে দেখিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতেমা কেয়া। তিনি বই রিভিউ করেন, সবচেয়ে বেশি থিম অনুযায়ী ছবি তোলেন, যেখানে তার ভাইবোনরাই মডেল হিসেবে থাকেন। তার মতে, তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এখন অনেক বইপ্রেমীর কাছে কনসেপ্টটি ছড়িয়ে গেছে। এটাও বললেন, থিমের মাধ্যমে বইয়ের আকর্ষণীয় অংশ তুলে ধরলে মানুষ ওই বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়, বইটি পড়তে চান। ঠিক এই কারণেই তিনি যেই বইগুলো কিনে বা উপহার পেয়ে পড়ে থাকেন ওই বইগুলোর ছবি তোলেন। কেয়ার কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে হয় মডেল প্রস্তুত করা, তার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন তার প্রিয় মা। তিনি আড়াইশর অধিক বই পেয়েছেন শুধু বুকোগ্রাফি করে। ‘দি সাইলেন্ট পেশেন্ট’খ্যাত অ্যালেক্স মাইকেলিডিস স্বয়ং ইন্সটাগ্রামে তার ছবির প্রশংসা করেছেন। গিফট ভাউচার, বর্ষসেরা বুকফটোগ্রাফার সম্মাননা, রাইটার্স ক্লাব সেরা বুকফটোগ্রাফারসহ অন্যান্য পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে।

সাইকেল চালিয়ে বই বিলি করেন

আতিফ আসাদ

জামালপুরসহ সারাদেশে বইপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম আতিফ আসাদ। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বই পৌঁছে দিচ্ছেন পাঠকের কাছে। তার জীবনের গল্পটা ১০টা মানুষ থেকে ভিন্ন। অর্থের অভাবে একাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি সহায়ক বই হিসেবে গাইড বা নোট কেনার সক্ষমতা ছিল না। আশপাশের বিভিন্নজনের থেকে সেগুলো সংগ্রহ করে পড়তেন। জানালেন তার গ্রামের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই নিজে কামাই করে পড়াশোনার খরচ বহন করে। তাদের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে পুরোদমে লেগে যান আতিফও। বার্নিশের কাজ, রাজমিস্ত্রির কাজ কিংবা কখনো টেক্সটাইল মিলে কাজ করেছেন। এখন তিনি স্নাতক করছেন সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে। একে একে গড়ে তুলেছেন ১৮টি পাঠাগার। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে প্রথম পাঠাগারের কার্যক্রম চালু করতে পাশের বাড়ির বোন থেকে ২০টি বই নিয়েছিলেন। এটাই ছিল তার পাঠাগারের জন্য প্রথম বই কেনা। যেখানে পাঠকের সংখ্যা ১৫শ ও বইয়ের সংখ্যা আট হাজার। ২০১৮-২০ সালে আতিফ পাঠকের বাড়িতে সাইকেলে করে বই পৌঁছে দিতেন, কেননা তার পাঠাগারে বসার যে খুব জায়গা ছিল না। ২০২২ সালে কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশন ক্যাটাগরিতে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন তিনি। তার স্বপ্ন দেশের ১০০টি রেলওয়ে স্টেশনে পাঠাগার গড়ে তোলার।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘সাহিত্যঘর পাঠশালা’

রিমন বড়ুয়া

করোনায় যখন সবাই ঘরবন্দি হয়ে মোবাইলে আসক্ত হয়ে বিষণ্নতায় ভুগছিল, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় সময় কাটছিল না, বাড়িতে বসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের প্রাণরসায়ন ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের ছাত্র রিমন বড়ুয়া উদ্যোগ নেন বই নিয়ে কাজ করার। নিজের কাছে তখন মাত্র দশটি বই ছিল। তা দিয়েই শুরু করেন ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। ফেসবুকে ‘আমার পাঠাগার’ নামে শুরু করেন বই ধার দেওয়া কার্যক্রম। এতে তার ফেসবুক বন্ধু থেকে শুরু করে ছোট-বড় অনেকেই যুক্ত হয় সদস্য হিসেবে। পাঠকের বাড়িতে বই দিয়ে আসা, পড়া শেষে আবার ফেরত আনা সবটাই রিমন করতেন। সকলকে বই পড়াতে পেরে তার ভালোলাগা কাজ করত। এর পর যখন ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি ‘আমার পাঠাগার’ থেকে ‘সাহিত্যঘর গণগ্রন্থাগার’ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেওয়াতে তার মনে অন্যরকম এক প্রশান্তি তৈরি হলো। রিমন মনে করেন বয়স কখনো কোনো কিছুর পথে বাধা হতে পারে না। ইচ্ছাশক্তি থাকলে যে কোনো বয়সেই স্বপ্ন পূরণ করা যায়। তার সঙ্গে প্রয়োজন পরিশ্রম। পড়ালেখার সুবাদে চট্টগ্রাম থাকা হয়, সেখানে থেকেই পরিচালনা করেন লাইব্রেরির সকল কার্যক্রম। ছুটিতে বাড়িতে এলেও ব্যস্ত থাকেন লাইব্রেরির কাজ নিয়েই। রামু ও চট্টগ্রাম মিলিয়ে দুই হাজার বই আছে রিমনের সাহিত্যঘর গণগ্রন্থাগারে।