বৈষম্য ঘোচানোই সত্যিকার মানবিক অর্জন
ধনকুবের ও মানবহিতৈষী বিল গেটস মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তেন। কিন্তু ডিগ্রি সম্পন্ন করার আগেই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এর ত্রিশ বছর পর ২০০৭ সালে হার্ভার্ডেই সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হন এবং তাকে সম্মানসূচক ডিগ্রিও প্রদান করা হয়। তিনি ওই বক্তৃতায় বলেছিলেন, ড্রপআউট হওয়ার পর কীভাবে তিনি বাস্তবের বিশ^ সম্পর্কে তিনি সম্যক ধারণা পেয়েছিলেন। ইংরেজি থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদ করেছেন আমাদের সময়ের সহকারী সম্পাদক জাহাঙ্গীর সুর
বিল গেটস
ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি অপেক্ষায় আছি। আমি অপেক্ষা করে বসে আছি, এটা বলার জন্য : ‘বাবা, আমি সবসময় আপনাকে বলেছি, [হার্ভার্ডে] আমি একদিন ফিরে আসব এবং আমার ডিগ্রি নেব।’
এই সময়োপযোগী সম্মানের জন্য হার্ভার্ডকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। হয়তো আগামী বছর চাকরিতে নতুন পদ-পদবি হবে। ভেবে ভীষণ ভালো লাগছে যে, শেষ পর্যন্ত আমার জীবনবৃত্তান্তে একটি কলেজ ডিগ্রির কথা উল্লেখ থাকবে।
স্নাতকদের সাধুবাদ জানাই, যারা আজ ডিগ্রি নিচ্ছে। তোমরা তো আমার মতো লম্বা বিরতির পর এ সম্মান পাচ্ছ না। তোমরা বিরতিহীন পড়াশোনা শেষে ডিগ্রিটা পাচ্ছ। আর আমার কথা যদি ধরো, তাহলে ক্রিমসনের কথা ধার করতে হবে। আমি খুশি, তিনি আমাকে ‘হার্ভার্ডের সবচেয়ে সফল ড্রপআউট’ বলে আখ্যা দেন। আমি অনুমান করি, এমন উপাধি আমাকে আমার নিজস্ব বিশেষ শ্রেণির ভ্যালিডিক্টোরিয়ান করে তোলে। মানে, পড়াশোনা সম্পন্ন করতে যারা ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মধ্যে আমি সেরাটা করেছি।
আরও পড়ুন:
ইবিতে শীতের আগমনী বার্তা
তবে আমি সেই মানুষ হিসেবেও স্বীকৃতি পেতে চাই, যে নাকি স্টিভ বলমারকে বিজনেস স্কুল থেকে বাদ পড়তে ভূমিকা রেখেছিল। ঠিক ধরেছেন, আমি প্রভাবক হিসেবে ভালো নয়। আর এ জন্যই বুঝি আমাকে তোমাদের স্নাতক অনুষ্ঠানে বক্ততৃা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। হলফ করে বলতে পারি, যদি তোমাদের নবীনবরণের অনুষ্ঠানে আমাকে কথা বলতে ডাকা হতো, তাহলে আজ হয়তো তোমরা হাতেগোনা কয়েকজন এখানে উপস্থিত হতে।
হার্ভার্ড আমার জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার জমিন। বিদ্যায়তনিক জীবন ছিল চিত্তাকর্ষক। আমি এমন অনেক ক্লাসে ঢুকে পড়তাম, যে ক্লাসের জন্য আমি ভর্তিই হইনি। আর ছাত্রাবাস জীবন ছিল ভয়ংকর। আমি র্যাডক্লিফে, কুরিয়ার হাউসে থাকতাম। গভীর রাত পর্যন্ত ডরমিটরিতে আমার ঘরে অনেকে আড্ডা মারত। কারণ সবাই জানত, আমি সকালে ওঠার বিষয়ে অতশত চিন্তা করি না। এভাবেই আমি অসামাজিক দলের নেতা বনে গেলাম। যেসব সামাজিক লোক আমার মতো অসামাজিকদের গোনায় ধরত না, আমরা সবাই এক দল হয়ে পরস্পরকে আঁকড়ে থাকতাম।
থাকার জন্য র্যাডক্লিফ ছিল দুর্দান্ত জায়গা। সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি ছিল। বেশিরভাগ পুরুষ শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান-গণিত নিয়ে পড়ত। এই চিত্রটি আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। আশা করি, আমি কী বলতে চাইছি তোমরা তা বুঝতে পারছ। কিন্তু এখানেই আমি শিখেছি, প্রতিকূলতা জয় করতে পারলেও তা সাফল্যের নিশ্চয়তা দেয় না।
হার্ভার্ডের আমার সবচেয়ে বড় স্মৃতিগুলোর একটি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির ঘটনা। আমি একদিন কুরিয়ার হাউস থেকে আলবুকার্কের একটি কোম্পানিতে কল করেছিলাম। এই কোম্পানি বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার তৈরি করা শুরু করেছিল। আমি তাদের কাছে সফটওয়ার বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
আরও পড়ুন:
আগামীর পৃথিবী হবে নিপীড়িত মানুষের
ধরেই নিয়েছিলাম, আমি যে ছাত্রাবাসের একজন ছাত্র, ওরা তা বুঝতে পারবে। আমাকে ঝুলিয়ে রাখবে। কিন্তু ওরা আমায় বলেছিল, ‘আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত নই, এক মাসের মধ্যে আমাদের সাথে দেখা করুন।’ এটা অবশ্যই ভালো খবর ছিল। কারণ, তখনো আমরা সফটওয়্যার তৈরিই করিনি। সেই মুহূর্ত থেকে, আমি এই সামান্য প্রকল্পে দিনরাত কাজ করেছি। এরই সুবাদে আমার কলেজ শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। এবং সূচনা ঘটেছিল মাইক্রোসফট নামের এক অসাধারণ যাত্রার। হার্ভার্ডের সম্পর্কে একটা কথাই বলব। শক্তিশালী ও বৌদ্ধিক ক্যাম্পাস এটি। উত্তেজনাপূর্ণ, ভীতিকর, কখনো কখনো এমনকি নিরুৎসাহিতকর মনে হতে পারে। কিন্তু এ শিক্ষালয় সবসময় চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করে। আমি আগেভাগেই এ ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু এরপরও বলব, আশ্চর্যজনক হার্ভার্ডই আমাকে রূপান্তর করেছিল আজকের আমি হতে। এখানে যাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, এখানে যে ধারণাগুলো নিয়ে কাজ করেছি, এগুলোই আমাকে আজকের আমি হতে ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু গম্ভীরভাবে ফিরে তাকালে আমার বড় অনুশোচনা হয়। আমি হার্ভার্ড ছেড়ে চলে যাই বিশ্বের ভয়ংকর অসাম্য সম্পর্কে কোনো বাস্তব সচেতনতা ছাড়াই। স্বাস্থ্য, সম্পদ ও সুযোগের ভয়ংকর বৈষম্য যা লাখ লাখ মানুষকে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে রাখেÑ এসব সম্পর্কে কোনো সচেতনতা আমার ছিল না।
আমি কিন্তু এই হার্ভার্ডে অর্থনীতি ও রাজনীতির নতুন নতুন ধারণা সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি। আমি এখানকার বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে দুর্দান্ত খবরাখবর জানতে পেরেছি।
কিন্তু মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ অগ্রগতি কেবল তার আবিষ্কারের মধ্যে নিশ্চিত হয় না। বরং সেই আবিষ্কারগুলো কীভাবে বৈষম্য কমাতে প্রয়োগ করা হয়, এর ওপর নির্ভর করে অগ্রগতি। গণতন্ত্র, শক্তিশালী জনশিক্ষা, মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা বা বিস্তৃত অর্থনৈতিক সুযোগের মাধ্যমে বৈষম্য ঘোচানোই হলো সর্বোচ্চ মানবিক অর্জন।
আমি হার্ভার্ড ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে এই দেশে শিক্ষার সুযোগ থেকে প্রতারিত লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর বিষয়ে খুব একটা জানতাম না। ড্রপআউট হওয়ার আগে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অবর্ণনীয় দারিদ্র্য ও রোগ নিয়ে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষ সম্পর্কেও আমি কিছুই জানতাম না। এসব খুঁজে বের করতে আমার কয়েক দশক লেগেছে।