আগামীর পৃথিবী হবে নিপীড়িত মানুষের

ফাতিমা মুসা মোহাম্মদ ।। অনুবাদ- জাহাঙ্গীর সুর
০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
আগামীর পৃথিবী হবে নিপীড়িত মানুষের

ইয়েমেনি মার্কিন আন্দোলনকর্মী। ফিলিস্তিনে ন্যায়বিচারের পক্ষে মার্কিন শিক্ষার্থীদের সংগঠনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। স্নাতক সম্পন্ন করার পর ১২ মে সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের স্কুল অব ল থেকে সমাবর্তন নেন। সেদিন সমাবর্তনে তিনি এই বক্তৃতা করেছিলেন। বক্তৃতায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন : যুক্তরাষ্ট্র এমন এক সাম্রাজ্য ধ্বংস ও সহিংসতার জন্য যার ভয়ঙ্কর ক্ষুধা রয়েছে; নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে দখলদার ইসরায়েল; যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পতন অনিবার্য। তার বক্তৃতা ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। বিশ^বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশের পর তার বক্তৃতা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, দুই সপ্তাহের মধ্যে অবশ্য তা পুনঃপ্রকাশ করা হয়। মাস ছয়েক আগের বক্তৃতা হলেও পড়লেই পাঠকের মনে হবে ফাতিমা যেন গাজায় চলমান ইসরায়েলি বর্বরতার কথাই বলছেন। মানে, ইসরায়েলের এই আগ্রাসী আচরণ নিত্যচিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আমাদের সময়ের সহকারী সম্পাদক জাহাঙ্গীর সুর

আইন মানুষের প্রয়োজনে প্রণীত হয়। ব্যবহৃত হয় মানুষের সেবায়। এই আদর্শকে সম্মান করে বলেই সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের স্কুল অব ল’ বেছে নিয়েছিলাম আমি। জানি, তোমাদের অনেকেই একই কারণে এই ক্যাম্পাস বেছে নিয়েছিলে। যুক্তরাষ্ট্রে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা এটা স্বীকার করে : আইন হলো শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের হাতিয়ার। কী যুক্তরাষ্ট্রে, কী সারা বিশে^, এই হাতিয়ার সাধারণ মানুষকে দমন ও নিপীড়ন করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

এ রকম পীড়ন থেকে আমাদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি দক্ষতা অর্জনের জন্য আমরা এই প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিয়েছিলাম। যারা কোনো প্রশংসা ছাড়াই, কোনো প্রচার ছাড়াই দিনের পর দিন সংগ্রাম করে যাচ্ছে, মানুষকে সংগঠিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তাদের রক্ষার জন্য আমরা আইনি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে চেয়েছিলাম। যারা ভোট দিতে পারে না, যারা পিএচডি গবেষণা করতে গিয়ে তহবিল পায় না, তাদের জন্য নিজেকে আমরা তৈরি করতে চেয়েছিলাম। যারা আইনি নিরপেক্ষতার মুখোশ উন্মোচন করতে চায়, যারা নিপীড়ন মোকাবিলা করার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে এবং এসব করতে গিয়ে যারা সহিংসতার শিকার হচ্ছে, তাদের জন্য আমরা আইনি দক্ষতা অর্জন করতে চেয়েছিলাম। নিপীড়নের এই ব্যবস্থা একটি সাম্রাজ্যকে অন্যায়ভাবে মদদ দেওয়ার জন্য। আর ধ্বংস ও সহিংসতার জন্য এই সাম্রাজ্যের ভয়ঙ্কর ক্ষুধা চোখে পড়ে।

সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের স্কুল অব ল’কে আমি সাধুবাদ দিই। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার দিয়েছে এই ক্যাম্পাস। ইসরায়েলি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠনের সুযোগও দেওয়া হয়েছে। আমাদের কথা বলার ও বিক্ষোভ করার অধিকারের পক্ষে বিবৃতিও দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রে খুব কম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ দিয়েছে।

দেখুন, ইসরায়েল নির্বিচারে উপাসকদের ওপর বুলেট ও বোমাবর্ষণ করে চলেছে। বৃদ্ধ ও যুবকদের হত্যা করছে। এমনকি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও কবরস্থানে আক্রমণ করছে। ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ও ব্যবসায়িকদের লক্ষ্যবস্তু করতে নিজেদের জনতাকেও প্ররোচিত করছে। ফিলিস্তিনি শিশুদের বন্দি করে রাখছে ইসরায়েল। বসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিকতার প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের তাদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত করছে। এখনো নাকবা চলমান। অনেক হয়েছে, আমাদের আর নীরব থাকা চলে না।

স্কুল অব ল’র কথা বাদ দিলে সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কিন্তু নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া। বর্ণবাদে ভরা। বেছে বেছে সুযোগ দেওয়ার প্রবণতা। এই প্রতিষ্ঠান আমাদের ব্যর্থ করতে চায়। অন্যদিকে তারা নিউইয়র্কের ফ্যাসিবাদী পুলিশ বিভাগ ও সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এই সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী আবার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, যার লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী সহিংসতা চালানো। একটি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান তার দাতাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তার ছাত্রদের জন্য নয়। নিজের শিক্ষার্থীদের প্রতি নয়, বরং দাতাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এক প্রতিষ্ঠান হলো সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক।

গাজার দিকে অন্তরচক্ষু দিয়ে তাকিয়ে দেখুন। এই সপ্তাহেও বোমা হামলা করা হয়েছে। বিশ্ব নিশ্চয়ই অন্ধ নয়। দখলদার রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিদিন বাদামি ও কালো চামড়ার ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে, দুনিয়ার মানুষ তা দেখছে। মনে করিয়ে দিচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারগুলোয় ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বন্দিরাও রয়েছে।

আমরা এখন থেকে প্রাক্তন শিক্ষার্থী হয়ে গেলাম। আজ এই ক্যাম্পাস ছেড়ে আমরা চলে যাচ্ছি। আমরা এমন এক পৃথিবীর কাছে এই ক্যাম্পাসকে রেখে গেলাম, আমাদের যে পৃথিবী অনেক প্রয়োজন। মুক্তির জন্য আমরা কল্পনার চেয়েও বেশি কিছু ত্যাগ করেছি। আমরা এই মিলনায়তনে যে আনন্দ করছি, উৎসব করছি, এই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের গ্রামের বাড়িতেও। শেখ জারাহ, অ্যাডেন, ইয়েমেন, হাইতি, পুয়ের্তো রিকো ও ফিলিপাইনেÑ সবখানেই এই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক। আমরা যেন নিউইয়র্ক সিটিতে আমাদের বাসায় ও খাবার টেবিলে বসে আনন্দ করতে পারি। আজকের এই আনন্দ, আজকের এই উৎসব বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদ, বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জ্বালানি হয়ে উঠুক।

আমরা আর অত্যাচারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করব না। তাদের বিকৃত চেতনায় আমরা আর ভরসা করব না। মহান ম্যালকম এক্স যেমন বলেছিলেন, আজ আমরাও সে রকম এই পৃথিবীতে আমাদের অধিকার ঘোষণা করছি। আমরা মানুষ। মানুষ হিসেবে মর্যাদার অধিকার আমাদেরও আছে। এই সমাজে, এই পৃথিবীতে, এই দিনে মানুষ হিসেবে সব অধিকার আমাদের দিতে হবে।

নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানের পতনের জন্য যারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের পাশে থাকব, আমরা তাদের রক্ষা করব। নিপীড়করা মনে করছে, তাদের পতন কেবলই অলীক, অবাস্তব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আগামীর পৃথিবী নিপীড়িত মানুষেরই হবে। ধ্বংসবাদী বড় বড় সাম্রাজ্যের পতন অতীতে ঘটেছে। আগামীতেও এমন সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য। তাই বন্ধুরা, সংগ্রাম শুরু হোক।