ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করুন
ডেঙ্গু নিয়ে জনগণের শঙ্কা ও উদ্বেগ বাড়ছে। প্রতিবছর এর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। একসময় ডেঙ্গু শুধু রাজধানী ঢাকার সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হতো, কিন্তু এখন রাজধানী ছাড়িয়ে অন্যান্য বড় শহর ও জেলা-উপজেলা শহরে বিস্তৃত হয়েছে। ফলে প্রায় সারাবছর চলমান এক জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে তথ্য জানা যায়Ñ জুলাইয়ে ১০ দিনে তিন হাজার ৬৩৫ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি বছর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৩ হাজার ৯৩১ জন। এদিকে গত বুধবার সকাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই সময়ে প্রাণ হারিয়েছে দুজন। সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে এক হাজার ২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৬১ জন, বাকি ৯২৫ জন অন্যান্য বিভাগে। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ৫৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এভাবে কি আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল প্রতিনিয়ত চলতেই থাকবে?
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও কয়েক বছর ধরে এটি অতীতের তুলনায় আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এই পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে, বাড়বে জনমনে আতঙ্ক ও দুর্ভোগ। কর্তৃপক্ষের কার্যকর পূর্বপ্রস্তুতি ও সমন্বয়ের অভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রতিবছর। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসচেতনতা বাড়াতে হবে ঠিকই, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই সচেতনতার বিষয়টি ঢাকাবাসী বুঝে গেছে। কোথায় এডিস মশা জন্মায় এ কথা এখন বেশির ভাগ মানুষ জানে। কিন্তু করণীয় যা তা করে না। তাই সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা মানাতে সচেতনতার পাশাপাশি কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ঢাকার বাইরে নাগরিকদের সচেতনতার অভাবে সবাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে হবেÑ দায় এড়ানো কথা না বলে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তা দ্রুত করুন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ডেঙ্গুর বিস্তারে আমাদের নগরায়ণ, অপরিকল্পিত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তন সরাসরি ভূমিকা রাখছে। এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার পানিতে প্রজনন করে, যেমনÑ ফুলের টব, ফ্রিজের ট্রে, ছাদের ড্রেন, টায়ার বা যে কোনো খোলা পাত্রে জমে থাকা পানি। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে যেখানে প্রতিদিন নতুন ভবন উঠছে, সেখানে নির্মাণাধীন স্থাপনায় জমে থাকা পানি বা ফেলে রাখা সামগ্রী মশার প্রজননের আদর্শ ক্ষেত্র তৈরি করছে। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বছরব্যাপী নয়, শুধু বর্ষাকাল এলেই কিছুটা তৎপরতা দেখা যায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, যেখানে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, সেখানে আজও অনেক হাসপাতালে প্লাটিলেট পরীক্ষা বা সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে গ্রাম বা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো রোগীর চাপে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। গুরুতর রোগীদের ঢাকায় পাঠাতে হয়। আমরা চাই, অন্তত দেশের সব বিভাগের হাসপাতালগুলো যেন গুরুতর ডেঙ্গু রোগীর পূর্ণ চিকিৎসা দিতে পারে।
ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সাধারণ জনগণÑ সবার অংশগ্রহণে গড়ে তুলতে হবে সর্বজনীন সচতেনতা এবং প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম। মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে, বাড়িতে ও আশপাশে জমে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শুধু ওষুধ ছিটালেই হবে না, সেটা যেন কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ডেঙ্গু প্রতিরোধ অসম্ভব নয়Ñ কিন্তু তার জন্য চাই সরকারের সদিচ্ছা, প্রশাসনিক তৎপরতা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমরা যদি এখনই উদ্যোগ না নিই, তাহলে অতীতের চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। সুতরাং সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। কেননা মানুষের জীবন নিয়ে অবহেলা করা কিছুতেই কাম্য নয়।