অস্পৃশ্য সত্তা দমনে লড়াই

মাকসুদুর রহমান
১২ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অস্পৃশ্য সত্তা দমনে লড়াই

মানুষকে তার পার্থিব জীবনে নিরন্তর যুদ্ধ করতে হয় নিজের সঙ্গে! অর্থাৎ তার আপন সত্তার সঙ্গে। প্রতিটি মানুষের অন্তস্তলে এক অস্পৃশ্য সত্তা বাস করে, যা কিনা সমগ্র মানবসমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা স্থিতিশীল কিংবা বিঘ্নিত করার প্রধান নিয়ামক শক্তি। অস্পৃশ্য সেই ভয়ংকর সত্তা হচ্ছে অহংকার। এটা এমন এক সত্তা, সমাজে যে মানুষটি চরম নিরংহকার হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য, তার ব্যক্তিজীবনের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করলেই প্রতীয়মান হবে যে, তিনিও অহংকার নামক অস্পৃশ্য সত্তার তীব্র দোষে দুষ্ট! আমরা চাই বা না চাই, মানবসৃষ্টির শুরু থেকে আমাদের মাঝে এই সত্তা বিরাজমান। আমাদের সমগ্র জীবন অস্পৃশ্য এই ভয়ংকর সত্তার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে করতে জীবন সায়াহ্নে পৌঁছতে হয়। গভীর হতাশার বিষয় হচ্ছে, আমরা এই গ্রহের বেশির ভাগ মানুষ আমাদের অন্তস্তলে অবস্থান করা অহংকার নামক অস্পৃশ্য সত্তার সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাস্ত হতে বাধ্য হই।

স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, একজন মানুষ যে এই অস্পৃশ্য সত্তা দ্বারা তীব্রভাবে আক্রান্ত তা বোঝার সহজ উপায় কী? চেনার উপায় খুব সহজ। আপনি যখন নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠÑ এই মনোজগতে বসবাস করতে যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত থাকবেন, তখনই বুঝতে হবে, আপনার মাঝে অহংকার নামক ভয়ংকর অস্পৃশ্য ক্ষতিকর এক পোকা বেড়ে উঠছে! একদিন এই অশরীরী পোকা বাহ্যিক নানা সত্তায় রূপান্তর ঘটে আশপাশের সমাজ, রাজনীতি, দেশ তথা আমাদের এই গ্রহকে অবাসযোগ্য করে তোলার যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করতে উদ্যত হয়।

২. মানুষের ব্যক্তিগত অনিয়ন্ত্রিত স্পৃহার ওপর ভিত্তি করে মূলত ভয়ংকর এই সত্তার সীমাহীন বাড়বাড়ন্ত ঘটে, যা একসময় মানুষের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দর্শনের পথ বেয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমাজ, রাষ্ট্র তথা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে। আজকের বিশ্বে মানুষের মাঝে সৃষ্ট তাবৎ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ কিংবা শান্তি বিঘ্নের প্রধান অনুষঙ্গ মূলত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার সেই বীভৎস স্পৃহা। পৃথিবীতে যে ধর্মীয় উন্মদনা আজ সমগ্র মানবসমাজকে ভয়ংকর পতনের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে, তার মৌলিক কারণ কিন্তু এটাই। অর্থাৎ মানুষের স্বীয় ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। অথচ মানুষ তার স্বীয় ধর্মীয় দর্শন প্রচারের ক্ষেত্রে মানবহৃদয় কিংবা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাকেই মূলভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করে! প্রতিটি ধর্মের মৌলিক সত্তা শান্তির কথা বললেও কেবল আলাদা আলাদা নাম কিংবা আলাদা আলাদা পরিচয় সৃষ্টির মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রবণতা থেকেই অশান্তির সূত্রপাত ঘটে।

৩. মানবসমাজের মনোজাগতিক রূপান্তর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মানুষের মাঝে সৃষ্ট বিশ্বাসজাত দর্শন মূলত তার মাতৃগর্ভ থেকে এই গ্রহে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকার সূত্রেই প্রাপ্তি ঘটে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের মনোজাগতিক এই প্রাথমিক রূপান্তর ধর্মীয় দর্শন কিংবা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার মধ্যে থেকেই ঘটতে শুরু করে। আর এর মাধ্যমেই মানুষের মনোজগতে ধীরে ধীরে বাসা বাঁধে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার এক বিরামহীন লড়াই! উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধর্মীয় দর্শন একসময় পরিবার, সমাজ, ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে দেশে দেশে ছড়িয়ে দিতে মানুষ নিরন্তর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়, যা একসময় ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে পরিবার থেকে সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা সমগ্র বিশ্বকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। মানুষের মাঝে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতার প্রাপ্তিযোগ পরিবার থেকেই ঘটে থাকে। পরবর্তীকালে তা মানুষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

৪. ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে মানুষ এক ধরনের শান্তির বাতাবরণের আবরণ ব্যবহার করলেও রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে এই আবরণ কার্যত খসে পড়ে! মূলত মানুষের অন্তস্তলে জেঁকে বসা অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিস্থাপনের এ অস্পৃশ্য সত্তার সর্বাধিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। পরিস্থিতি কখনও কখনও এমন রূপ ধারণ করে যে, কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিবিশেষের আচার-আচরণ সাধারণ ভদ্রতার সীমারেখাকে অতিক্রম করে। তাদের আত্মম্ভরিতা অত্যন্ত কদর্যভাবে সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশকে বিষিয়ে তোলে। দেশীয় ও বৈশ্বিক রাজনীতির বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের এ ধরনের আচার-আচরণ আমাদের পরিচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে চরম অস্থিরতা, তা সৃষ্টির পেছনেও কিন্তু রয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনগত শ্রেষ্ঠত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার নিরবচ্ছিন্ন অপতৎপরতার ফল। বিশেষ কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির সীমাহীন আত্ম-অহমিকাই বস্তুত আমাদের সমাজ, রাজনীতি এমনকি সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে গলাধঃকরণে উদ্যত হয়েছিল। পরিণতিতে, এদের ঔদ্ধত্যের নির্মম বলি হয়ে প্রাণ দিয়েছে হাজারো শিশু-কিশোর ও টগবগে তরুণ। একই রকমভাবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে সর্বসাম্প্রতিক কালে মধ্যপ্রাচ্যের গাজায় হাজার হাজার শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতীর নির্মম হত্যাকাণ্ড ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠারই করুণ উদাহরণ!

মানুষের মাঝে নীরবে বসবাসকারী এই ক্ষতিকর অস্পৃশ্য সত্তার যাতে বাড়বাড়ন্ত না হতে পারে, তার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত লড়াই, যাতে অহংকার নামক অস্পৃশ্য এই সত্তা আমাদের মস্তিষ্ককে আবিষ্ট করে না ফেলে। কারণ, অহংকার নামক অস্পৃশ্য সত্তার তীব্র উত্তাপ আমাদের অন্তরাত্মাকে বিলীন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, যার চূড়ান্ত পরিণতি মানবসমাজের অবধারিত পতন। তা ব্যক্তি, সমাজ, জাতি কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবন, যাই হোক না কেন। মানুষকে নিজেকে অর্থাৎ নিজের আপন সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, স্থূলভাবে বললে মানুষের নিজ নিজ অবস্থান থেকে অনিবার্য পতন ঠেকাতে হলে তার অন্তস্তলে অবস্থানকারী অহংকার নামক অস্পৃশ্য সত্তাকে অবদমনে রাখার লাগাতার লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।

চলুন, আমি ও আমরা আমাদের ভেতরে বসবাসকারী অহংকার নামক অস্পৃশ্য সত্তা নিয়ন্ত্রণে নিরন্তর লড়াই জারি রাখি, যাতে আমাদের অন্তস্তলে বসবাসকারী নির্জীব অস্পৃশ্য সত্তা ন্যূনতম মাত্রায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে সক্ষম না হয়; নিঃসন্দেহে যা আমাদের সমাজ, দেশ, জাতি কিংবা রাষ্ট্রকে অধিকতর বাসযোগ্য করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।


মাকসুদুর রহমান : রাজনৈতিক গবেষক