এএফসি এশিয়ান কাপ রাঙাবেন লড়াকু মেয়েরা
পুরুষ জাতীয় ফুটবল দলের কাছে এশিয়ান কাপ বহু বহুদিন ধরে অধরা। ক্রীড়ামোদীরা তাই ভুলেই গেছেন এশিয়ার ফুটবলের সেরা এই মঞ্চে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বছর বা দিনক্ষণ। কিন্তু ছেলেরা না পারলেও মেয়েরা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এএফসি এশিয়ান উইমেন এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে নাম লিখিয়ে রীতিমতো এক নতুন ইতিহাস গড়তে সক্ষম হয়েছেন। বাফুফের সুপরিকল্পনা আর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই মেয়েরা এই গৌরবজনক অধ্যায় রচনা করেছেন। খুব কম সময়ের ব্যবধানে নারী ফুটবল দলের এমন সাফল্যকে কেউ কেউ নারী জাগরণের প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। আসলে বিষয়টি সে রকমই। বাছাই পর্বের লড়াইয়ে একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বী বাহরাইন, মিয়ানমার ও তুর্কমেনিস্তানকে হারিয়ে ভীষণরকম রঙ ছড়িয়ে দেশের মেয়েরা এক অসাধ্যকে সাধন করেছেন। সত্যিই মেয়েদের এই সাফল্য সব কল্পনাকেও যেন হার মানিয়েছে।
গ্রুপ পর্বের লড়াইয়ে বাংলাদেশ ছিল অদম্য। যারা সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্য কোনো প্ল্যাটফর্মে খেলা দেখেছেন তারা উপলব্ধি করেছেন, কোনো জয়ই মেয়েরা ভাগ্যের জোরে পাননি। প্রতিটি জয় তারা কেড়ে নিয়েছেন সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে, যেখানে লড়াকু মনোভাবটা ছিল ভীষণরকম পরিস্ফুটিত। মিয়ানমারের বিপক্ষে ঋতুপর্ণা চাকমার করা জোড়া গোল এখনও সবার চোখের সামনে লেগে আছে। ঋতুপর্ণা চাকমা, আফঈদা, মণিকা, শামসুন্নাহারÑ সবাই অসাধারণ খেলেছেন। কোচ বাটলার যথার্থই বলেছেন। দেশের এক শীর্ষ পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বুদ্ধিমত্তা আর সৃজনশীলতার সমন্বয়েই তৈরি হয়েছে এক শক্তিশালী দল, যেখানে কঠোর পরিশ্রমের পরিস্ফুটিত রূপ দেখা গেছে। তিনি আরও বলেছেন, ‘এটি ব্যক্তিগত নয়, সম্মিলিত সাফল্য।’ বাটলারের এই মূল্যায়ন খুবই সঠিক। কোনো খেলাধুলাতেই রাতারাতি সাফল্য পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ক্রীড়াক্ষেত্রে যে কোনো ইভেন্টে সাফল্য পেতে হলে প্রয়োজন কঠোর অনুশীলন, প্রয়োজন আত্মনিবেদন। এখানে ঘাটতি থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। আমাদের মেয়েরা সেটা করতে পেরেছেন। আসলে কোচ বাটলার সব সামলে সত্যিই নতুন এক উপহার দিয়েছেন গোটা দেশকে। কেননা কিছুদিন আগেই কোচ বাটলারের সিদ্ধান্ত ঘিরে নারী ফুটবল দলে বড় এক বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। সাবিনাদের নেতৃত্বে সেই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন ১৮ নারী ফুটবলার। এ বছরের ৩০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন ফুটবলাররা। এরপর তাদের বিদ্রোহ নিয়ে পানি গড়ায় অনেক দূর। ১৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের অবসান ঘটে। অবশেষে বাফুফের হস্তক্ষেপে পর্যায়ক্রমে মেয়েরা অনুশীলনে যোগ দেন। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি ও ২ মার্চ আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য দেশ ছাড়েন নারী ফুটবলাররা। কিন্তু দুটি ম্যাচেই বাংলাদেশের মেয়েরা পরাজিত হন। তবে সেই পরাজয়ের সব গ্লানি ভেঙেচুরে বাংলাদেশের মেয়েরা নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয়েছেন।
আগামী বছরের মার্চে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্ব। সেখানে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশও খেলবে। এবারের এএফসি উইমেন এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলবে মোট ১২টি দেশ। এর মধ্যে বাছাই পর্বে লড়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে হচ্ছে ৮টি দেশকে। আর সরাসরি খেলবে আয়োজক অস্ট্রেলিয়া এবং গত টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন চীন, রানার্স আপ দক্ষিণ কোরিয়া এবং তৃতীয় স্থান অর্জনকারী জাপান। এবার বাছাই পর্বে অংশগ্রহণ করে মোট ৩৪টি দেশ। ফিফার গাইডলাইন মোতাবেক এই ৩৪টি দেশকে মোট ৮টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। দুটি গ্রুপে ৫টি করে দল এবং ৬টি গ্রুপে ৪টি করে দল অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরই মধ্যে গ্রুপ ‘বি’ থেকে ভারত, গ্রুপ ‘সি’ থেকে বাংলাদেশ, গ্রুপ ‘ডি’ থেকে চায়নিজ তাইপে, গ্রুপ ‘ই’ থেকে ভিয়েতনাম, গ্রুপ ‘এফ’ থেকে উজবেকিস্তান, গ্রুপ ‘জি’ থেকে ফিলিপাইন এবং গ্রুপ ‘এইচ’ থেকে নর্থ কোরিয়া চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে। ‘এ’ গ্রুপের খেলা এখনও শেয় হয়নি। জর্ডানে অনুষ্ঠিত এই গ্রুপের খেলা শেষ হবে ১৯ জুলাই।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এ দেশের মানুষের প্রাণের খেলা ফুটবল নিয়ে আমাদের ক্ষোভ-আক্ষেপের অন্ত নেই। এর প্রধানতম কারণ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে উঠতে না পারা এবং বাছাই পর্বেই আমাদের বেহাল অবস্থা। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বাংলাদেশের ফুটবল আমুদেরা ভীষণ ক্লান্ত। বহু বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও আমাদের তাই সাফ ফুটবলের জিগির তুলেই তুষ্ট থাকতে হয়। পুরুষ ফুটবল দল ফুটবল ইতিহাসে সেই কবে একবারই খেলেছে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে। গত ৪৫ বছরে আর একবারও বাংলাদেশের কোটি কোটি ফুটবল দর্শক এশিয়ান লেভেলে লড়াই করার যে আনন্দ তা গ্রহণ করতে পারেননি। সেই ক্ষোভ আর আক্ষেপ তাই কিছুটা হলেও এতদিন পর আমাদের লড়াকু মেয়েরা যে মেটাতে সক্ষম হবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের মেয়েরা খেলবেন এএফসি কাপের ২১তম আসরে। এএফসি উইমেন এশিয়ান কাপের সূচনা হয় ১৯৭৫ সালে। সেবার এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের দায়িত্বে থাকে এশিয়ান লেডিস ফুটবল কনফেডারেশন (এএলএফসি)। সে সময় দুই বছর পর পর এই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হতো। ২০১০ সাল থেকে চার বছর পর পর নারী এশিয়ান কাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্যন্ত মোট ২০ বার আয়োজিত এই টুর্নমেন্টে চীনের মেয়েরা সর্বোচ্চ নয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। অন্যদিকে মোট তিনবার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে উত্তর কোরিয়া ও চায়নিজ তাইপে। জাপান চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দুবার। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড একবার করে চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছে। আমরা আশা করছি, এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত এই আসরেও উজ্জীবিত ফুটবল খেলবেন ঋতুপর্ণা, আফঈদারা।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বাংলাদেশের মেয়েরা যে সাফল্য দেখিয়ে চলেছেন তা তুলনাহীন। কিন্তু মেয়েরা যতই চকচকে সাফল্য দেখান তাদের বৈষম্য-বঞ্চনাটাও আবার অনেক বড়সড়। এই যে ছোট ছোট মেয়েরা সবকিছু ফেলে শুধু দেশের জন্য আত্মনিবেদন করলেও তাদের আর্থিক ঝুঁকি মারাত্মক। নামকাওয়াস্তে তাদের মাসিক বেতন দেওয়া হয়। মিয়ানমার থেকে এত বড় সাফল্য আনলেও রাতে হাতিরঝিলে রঙবাহারি সংবর্ধনা দিলেও খোদ বাফুফে তাদের হাতে কোনো নগদ পুরস্কার তুলে দিতে পারেনি। আর তাই মধ্যরাতে বাফুফের তরফে দেওয়া সংবর্ধনা নিয়েও নানা কথা উঠেছে। বাফুফের টাকাওয়ালা কর্মকর্তাদের বোঝা উচিতÑ নারী ফুটবল দলের প্রত্যেকেই প্রান্তিক পরিবার থেকে উঠে আসা। ঋতুপর্ণা, মণিকা, আফঈদা, শামসুন্নাহারÑ কেউই ধনীর দুলালী নন, কেউ শখ করে খেলতে আসেননি। এত বড় সাফল্যের পরও বাফুফের পক্ষ থেকে তাদের হাতে নগদ অর্থ পুরস্কার তুলে না দেওয়াটা দুঃখজনক। বাফুফের কর্মকর্তারা এই অভিযোগ কখনোই এড়াতে পারবেন বলে মনে হয় না। সাফল্য যাদের হাত ধরে আসে তাদের সঠিক মূল্যায়ন না করাটা খুবই অন্যায়। কোচ, খেলোয়াড়Ñ সবার জন্য নগদ অর্থ পুরস্কার দেওয়া হলে টিমে আরও নতুন শক্তি সঞ্চারিত হতো।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জাহিদ রহমান : ক্রীড়ালেখক ও গবেষক