ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সহায়তার অবস্থান

মাহফুজুর রহমান
১১ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সহায়তার অবস্থান

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক অগ্রগতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কুটির শিল্প, ক্ষুদ্রশিল্প এবং মাঝারিশিল্পের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক সুদৃঢ় অবস্থান তৈরিতে এসব ক্ষুদ্রশিল্পের অবদানের কথা শুনে থাকি। প্রথমেই আসা যাক, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত প্রসঙ্গে। দেশটির জিডিপির প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ এবং রপ্তানির শতকরা ৪৫ ভাগ আসে এই ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারিশিল্প থেকে। ভারতের ১১ কোটি মানুষের জন্য এই খাত থেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান মাইক্রো ইউনিটস ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফাইন্যান্স এজেন্সি (মোড্রা) এ খাতের উদ্যোক্তাদের ৫০ হাজার রুপি থেকে শুরু করে ১০ লাখ রুপি পর্যন্ত ঋণ প্রদান করে থাকে। তা ছাড়া সরকারি উদ্যোগে খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

ক্ষুদ্রশিল্পে চীনের সফলতার কথা বিশে^র সর্বত্র আলোচিত। চীনের কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প থেকে জিডিপির শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ এবং কর্মসংস্থানের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ অর্জিত হয়ে থাকে। চীনের ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শতকরা ২০-২৫ ভাগ ঋণ বাধ্যতামূলকভাবে এই খাতে বিতরণ করতে হয়।

ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, দেশটির মোট কর্মসংস্থানের শতকরা ৯৭ ভাগ এবং ব্যবসায়ের শতকরা ৯৯ ভাগ সরাসরি এই খাতের ওপর নির্ভর করে আছে। এ ব্যাপারে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপিন্সের উদ্যোগও প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশেও কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র এবং মাঝারিশিল্পের উন্নয়নের জন্য ব্যাংক ও সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। এ দেশের অর্থনীতিতে আলোচ্য খাতের অবদান শতকরা প্রায় ৩২ শতাংশ। দেশের আড়াই কোটিরও অধিকসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এই খাত। কিন্তু সরকারি নানা উদ্যোগের পরও বাস্তবায়ন পর্যায়ের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আন্তরিকতার অভাবে মাত্র ৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের আওতায় রয়েছে। বাকি ৯১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান মহাজনি ঋণ গ্রহণ করছে বা ঋণের অভাবে এগোতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট ঋণের শতকরা ২৫ ভাগ অবশ্যই ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারিশিল্পে খাটাতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এরূপ ঋণের পরিমাণ মাত্র শতকরা ১৮ ভাগের কম।

গত ২৭ জুন ছিল বিশ^ ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প দিবস। বিশ^ অর্থনীতিতে এই খাতের অপরিসীম অবদানের স্বীকৃতি এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ^ব্যাপী দিনটি উদযাপিত হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে চালু হওয়া এই দিবসের চলতি বছরের মূল প্রতিপাদ্য ছিল, টেকসই প্রবৃদ্ধি ও উদ্ভাবনের চালিকাশক্তি হিসেবে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (এসএমই) ভূমিকা জোরদারকরণ।

বাংলাদেশে গত ২০২২ সালে এসএমই খাতে ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ২৪ হাজার ১৯৩টি। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে এই ঋণগ্রহীতার সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বেড়ে ২০২৫-এর শুরুতে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৬টি। ২০২৩ সালে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৩১২ কোটি টাকা যা ২০২৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণের এরূপ অবনতির কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোতে দৃশ্যমান করোনা পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেনসহ অন্যান্য দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পটপরিবর্তনজনিত ঝুঁকি, কর্মপরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রতিবন্ধকতা, বাজারের অনিশ্চয়তা ইত্যাদির ফলেই আলোচ্য খাতের প্রবৃদ্ধি ঘটেনি এবং বিদ্যমান ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমেছে। একই রূপ কারণে দেশের করপোরেট হাউসগুলোও নানাবিধ সমস্যায় ভুগেছে বিধায় তাদের ওপর নির্ভরশীল এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিকূল সময় কাটিয়েছে। ফলে এ খাতে ঋণের যথাযথ প্রবৃদ্ধি ঘটেনি।

২০২০ সালে সিএমএসএমই খাতে সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বলে নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তা ছাড়াও বিদ্যমান মন্দাবস্থা কাটাতে নানাবিধ প্যাকেজ প্রদান করা হয়। এ ধরনের আনুকূল্য পাওয়ার পর খাতটি ক্রমে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। কিন্তু এরই মধ্যে আবার সুদহার বাজারভিত্তিক করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যে উল্লম্ফন এসএমই খাতের অগ্রগতির পথে ব্যাপক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কর্তৃক প্রদত্ত শর্তের আওতায় এসএমই খাতের জন্য আগে বিদ্যমান সাধারণ প্রভিশন হার (শতকরা ০.২৫ টাকা) প্রত্যাহার করে অন্যান্য ঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে একীভূত করায় অর্থৎ প্রভিশন গড়পড়তা শতকরা ১ ভাগে বহাল করায়, ব্যাংকগুলো এই খাতে টাকা বিনিয়োগে উৎসাহ হারাচ্ছে। বৃহৎ ঋণ অপেক্ষা এসএমই খাতে ঋণ প্রদান ও আদায়ের পর্যায়ে অধিক লোকবল লাগে বলে ব্যাংকের ব্যয় বেশি হয়ে থাকে। আবার ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতাদের জন্য পৃথক নিয়মে, অর্থাৎ তাদের প্রকৃত সুবিধা বা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে, রিশিডিউল করার ব্যবস্থা নেই।

দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল ও ঊর্ধ্বমুখী করতে হলে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই; অন্তত বাংলাদেশের মতো দেশে। সে বিবেচনায় যেভাবেই হোক, এ খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে হবে, নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং খাতসংশ্লিষ্টদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের সমন্বয় করতে হবে। এজন্য বর্তমান পর্যায়ে যেসব বিষয়ের ওপর সরকারকে নজর দিতে হবে সেগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশে নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করা অত্যন্ত কঠিন। নতুন প্রজন্মের তরুণরা নানা ধরনের আইডিয়া ডেভেলপ করতে পারে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবায়নের পথে ফিজিবিলিটি স্টাডিসহ নানা অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকে। এগুলোর ভেতর প্রকল্পে অর্থায়ন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ২১ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একটি স্টার্টআপ তহবিল গঠন করেছে। এতে তাদের নিজস্ব তহবিলের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটি অংশ থাকবে। এই প্রকল্পের আওতায় স্টার্টআপ উদ্যোগকে মাত্র ৪ শতাংশ সুদহারে ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হবে। এই পদক্ষেপ স্টার্টআপ ব্যবসায়ীদের আশার আলো দেখাবে এবং বাংলাদেশে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ ত্বরান্বিত হবে। ফলে উৎপাদন, রপ্তানি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক ধারার সূত্রপাত ঘটবে। তবে ব্যবসা শুরু করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি ও আইনশৃঙ্খলা অনুকূল রাখার দায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হবে।

বর্তমানে একজন উদ্যোক্তার অনুকূলে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) রক্ষিত তথ্য যাচাই করার পাশাপাশি আরও বহু ধরনের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করতে হয়। এতে ব্যাংকের দিক থেকেও খরচ বাড়ে। ফলে সুদের হারও বেশি আদায় করতে হয়। এরূপ খরচ কমানোর লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক শিগগিরই প্রাইভেট সেক্টরে তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহকারী ক্রেডিট ব্যুরোর লাইসেন্স ইস্যু করতে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুততর সময়ে চালু করা প্রয়োজন। এতে করে ব্যাংক সহজে এবং কম খরচে ঋণ গ্রহীতার বিষয়ে তথ্য জানতে পারবে এবং সহজে ঋণ বিতরণ করতে পারবে। বর্তমানে অনেকগুলো ব্যাংক দেশের সর্বত্র এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করেছে। ক্ষুদ্রশিল্পে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এসব এজেন্ট ব্যাংকের সেবা চালু করা যেতে পারে। তাতেও ব্যাংক, এজেন্ট এবং ঋণ গ্রহীতারা উপকৃত হবেন।

এ বিষয়ে শেষ কথা, যেমন করেই হোক দেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে; কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পের অনুকূলে কম সুদহারে ঋণ সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে, উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ এবং মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। তা হলেই দেশে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে এবং অর্থনীতিতে ইতিবাচক গতিশীলতা তৈরি হবে।


মাহফুজুর রহমান : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক