দুঃশাসনের কবলে ইরান

মযহারুল ইসলাম বাবলা
০৮ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
দুঃশাসনের কবলে ইরান

ইরান শিক্ষা, সংস্কৃতিতে অগ্রসর জাতি হিসেবে তারা সহস্র বছর আগে থেকেই সমৃদ্ধ। পারস্যের ফার্সি ভাষা-সাংস্কৃতিক আধিপত্য কেবল ইরানকেন্দ্রিক ছিল না। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। ফার্সি ভাষা কেবল ইরানে সীমাবদ্ধ ছিল না। ফার্সি ভাষা অনেক দেশে বিস্তারের মতো আমাদের উপমহাদেশেও বিস্তার লাভ করেছিল। মোগলদের শাসনামলে ভারতবর্ষে ফার্সি রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। এমনকি ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনামলে একশ বছরের অধিককাল ফার্সি ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। উর্দু ভাষার উৎপত্তির মূলে ফার্সি ভাষা। মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে পারস্যের ফার্সিভাষী সৈন্যদের সঙ্গে ভারতীয় সৈন্যদের কথোপকথনের নিমিত্তে ফার্সি বর্ণমালা এবং হিন্দুস্থানি ভাষার মিশ্রণে উর্দু ভাষার সৃষ্টি। উর্দু মিশ্র ভাষা। যার বর্ণমালা ফার্সি। আমাদের উপমহাদেশে ফার্সি ভাষা-সংস্কৃতির প্রভাব ও প্রচলন বহু আগে থেকেই ছিল। মোগলদের প্রাসাদ-স্থাপনাগুলো নির্মাণে পারস্যের স্থাপত্য শিল্পের অনুকরণ করা হয়েছিল। যার নিদর্শন মোগলদের নির্মিত প্রায় সব স্থাপনায় দৃশ্যমান। মোগলদের নির্মাণযজ্ঞে পারস্যের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ কারিগরদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। ভারতজুড়ে মোগলদের নির্মিত সব স্থাপনায় পারস্যের স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে। আমাদের দেশে যে সুফিবাদের প্রচলন ঘটেছে তারও উৎস পারস্য বা ইরান। আমাদের কথিত ও লিখিত প্রচুর শব্দ রয়েছে যেগুলো ফার্সি। ফার্সির বহুল ব্যবহারে কালের ব্যবধানে উপমহাদেশের নানা ভাষায় ফার্সি শব্দ স্থান করে নিয়েছে। ধর্মীয় আচারেÑ খোদা, খোদা হাফেজ, নামাজ, রোজা, শবেকদর, আখেরি চাহার সোম্বা ইত্যাদি ফার্সি শব্দ, আরবি নয়। জনাব ফার্সি শব্দ অর্থাৎ মহোদয়, জনাবা ফার্সি শব্দ কিন্তু জনাবা ফার্সি ভাষায় পতিতা।

ইরানে ইসলাম ধর্ম প্রবেশ করতে পেরেছিল কিন্তু আরবি ভাষা-সংস্কৃতি প্রবেশ করতে পারেনি। ইরানিরা ইসলাম গ্রহণ করলেও সচেতনভাবে আরবি ভাষা-সংস্কৃতি পরিত্যাগ করেছিল। নিজেদের সমৃদ্ধ ভাষা-সংস্কৃতি ত্যাগ না করে। ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার কারণে একমাত্র নামাজ আদায়ে আরবি ভাষা ব্যবহারে তারা বাধ্য। এ ছাড়া অপর কোনো ধর্মীয় আচারে আরবি ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেনি। ইরানের শিক্ষার ক্ষেত্রেও ফার্সি ভাষার একক প্রচলন বহুকালের। চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলশাস্ত্রসহ সব শিক্ষাব্যবস্থায় ফার্সি ভাষা একমাত্র মাধ্যম। পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি কেবল ভাষা-শিক্ষার পাঠ্যরূপে রয়েছে। ইরানের রেজা শাহ পাহলভীর শাসনামলে শাসন কাঠামোর অন্তর্গত সুবিধাবাদী শ্রেণিদের জন্য সীমাবদ্ধ ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানিরা প্রবেশের সুযোগ বঞ্চিত ছিল যেমন, তেমনি তাদের অর্থনৈতিক কারণে উপায়ও ছিল না। শাহের শাসনামলে শাসকগোষ্ঠীর অন্তর্গত সংখ্যালঘু সুবিধাবাদী শ্রেণি পশ্চিমা শিক্ষা বেছে নিয়েছিল নিজেদের আভিজাত্য প্রকাশে এবং পশ্চিমা প্রীতিতে। ইরানিরা নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে আগাগোড়া সচেতন। বিশাল আরব ভূখণ্ডের নিকটবর্তী হয়েও নিজেদের ফার্সি জাতীয়তাবাদীরূপে প্রমাণ দিয়ে এসেছে। আরবিভাষী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইরানিদের দূরত্বের মূলে শিয়া মতবাদ পাশাপাশি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা। ধর্মীয় জাতীয়তাকে এড়িয়ে ভাষাগত জাতীয়তাকে তারা সুদীর্ঘকাল সমুন্নত রেখেছে। ইরানে সুন্নির সংখ্যা অতিনগণ্য। ইরানে ইসলাম ধর্মের প্রবেশ ও বিকাশের পর পরই পার্সিসহ পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বীদের তারা বিতাড়িত করেছিল। অতি ক্ষুদ্র নগণ্যসংখ্যক পার্সি-পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বীরা ইরানে থাকলেও মূলধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং সংখ্যা বিচারে এতই নগণ্য যে, তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিবেচনা করা যাবে না। ভারতবর্ষে প্রচুর পার্সি (অগ্নি উপাসক) আশ্রয় নিয়ে আছে।

ইরানের স্বৈরশাসক রেজা শাহ পাহলভী ছিলেন ব্রিটিশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ক্ষমতাকে স্থায়ী ও নিরঙ্কুশ রাখার অভিপ্রায়ে দেশের তেলসম্পদ ব্রিটিশ-মার্কিনিদের হাতে তুলে দিতে পর্যন্ত দ্বিধা করেননি। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার এমন নজির বিশ্বের প্রায় সব স্বৈরশাসকের মধ্যে লক্ষ করা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ক্ষুণ্নে ইসরায়েলিদের ফিলিস্তিনের আগ্রাসনে এবং মার্কিনিদের তাবৎ অপকীর্তিতে শাহ ছিলেন প্রকাশ্যে তাদের সমর্থক। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র দখলকে কেন্দ্র করে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে সমগ্র আরব রাষ্ট্র যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হয়েছিল একাট্টা, করেছিল যুদ্ধও। তখন রেজা শাহ পাহলভী নির্লিপ্ত থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নির্লজ্জ তাঁবেদাররূপে ইসরায়েলের পক্ষে ছিল।

শাহের শাসনামলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শোষণ-বঞ্চনার শিকার হলেও সংখ্যালঘু সুবিধাবাদী শ্রেণি এবং পুলিশ-সাভাক নামক দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা বাহিনী এবং সামরিক বাহিনী ছিল শাহের বলপূর্বক অপশাসনের সঙ্গী। শুরুতে শাহবিরোধী আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন সম্ভব হলেও শেষে আর সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা ছিল সোভিয়েতপন্থি তুদেহ পার্টি (কমিউনিস্ট)। আজকের ইরানের ইসলামি বিপ্লবীপন্থিরা শাহবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল দ্বিতীয় সারিতে। প্রথম সারিতে সমাজতন্ত্রী তুদেহ পার্টিসহ দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো। এজন্য ইসলামি বিপ্লব-পরবর্তী তাদের চরম মূল্যও দিতে হয়েছিল। উপমহাদেশের কমিউনিস্টদের মতো ভুলের শিকার তুদেহ পার্টি এবং প্রগতিবাদীরা। মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক খোমেনিপন্থিদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে শাহবিরোধী আন্দোলনের মুখে ১৯৭৯-তে শাহের পতন ঘটে। কিন্তু মৌলবাদীদের কৌশলের কাছে হার মেনে ক্ষমতা প্রাপ্তি তো বহু পরের কথাÑ প্রগতিবাদীরাসহ তুদেহ পার্টির নেতাকর্মীরা জীবন রক্ষা পর্যন্ত করতে পারেনি।

ইরানের তথাকথিত ইসলামি বিপ্লবী ধর্মান্ধ শাসন ৪৬ বছর নিরঙ্কুশভাবে টিকে থাকার পেছনে মার্কিনি অবদান অনস্বীকার্য। ইরানবিরোধী যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ, যুদ্ধ, অব্যাহত চাপ, হুমকি প্রভৃতিতে ইরানের জনগণ মাত্রই মার্কিনবিরোধী। ক্ষমতাসীন মৌলবাদী শাসকরাও মার্কিন বিরোধিতাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে নিরঙ্কুশ শাসনব্যবস্থা অটুট রেখেছে। সমষ্টিগত জনগণ ও শাসকদের মার্কিনবিরোধী ঐক্যের কারণেই পশ্চাৎপদ মৌলবাদী শাসন বহাল তবিয়তে রয়েছে। ইরানে নারীদের হেজাব বাধ্যতামূলক। নারী স্বাধীনতা সেখানে কল্পনার অতীত। মুক্তচিন্তার অধিকার নেই। নারীকে বেত্রাঘাতসহ মধ্যযুগীয় বর্বরতায় নিষ্ঠুর শাস্তি প্রদানের অজস্র ঘটনা ঘটে এসছে।

গোয়েন্দা নজরদারিসহ মধ্যযুগীয় মৌলবাদী শাসনের শৃঙ্খলে ইরানি জনগণ কার্যত শৃঙ্খলিত। আর এই বন্দিত্ব দীর্ঘায়িত হতে পেরেছে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ইরানবিরোধী নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে। ইরান ত্যাগীদের সবাই রেজা শাহের অনুগত ছিল না। প্রগতিবাদী-মুক্তচিন্তার অগণিত ইরানি ধর্মীয় মৌলবাদী শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। নাৎসি বাহিনীর মতো মৌলবাদী সশস্ত্র বাহিনীর তীক্ষè নজরদারি জারি রয়েছে জনগণের ওপর। নির্বাচনে ভোট প্রদান নিশ্চয় গণতন্ত্রের একমাত্র মাপকাঠি নয়। অতীতের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা সীমিত। সর্বময় ক্ষমতা ইসলামি বিপ্লবী মজলিসের। বিশেষভাবে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার হাতের মুঠোয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রেজা শাহের আমলেরই ধারাবাহিকতা। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে কার্যত ইরানে কিছু নেই। প্রাচীন সভ্যতার ইরান বহির্বিশ্বের শত্রু প্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জন করলেও শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির পীঠস্থান ইরানকে মৌলবাদী শাসনের বৃত্তে একে একে সব ঐতিহ্য হারাতে হয়েছে। যে ইরানি জনগণ স্বৈরশাসক রেজা শাহ পাহলভীর মতো লৌহমানবকে বিতাড়িত করার গৌরবের অধিকারী, অথচ সেই জনগণ মৌলবাদী স্বৈরশাসন বিনা বাধায় ৪৬ বছর মেনে নিয়ে নিশ্চুপ রয়েছে। ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধে এবারই প্রথম ইসরায়েল আক্রান্ত হয়েছে। অতীতে কখনও এরূপ আক্রমণের শিকার তাদের হতে হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পর্যন্ত ইরান তোয়াক্কা করেনি। যদি বহিঃশত্রুর একের পর এক আগ্রাসনের মুখে তাদের পড়তে না হতো, তাহলে বহু আগেই পরিস্থিতি পাল্টে যেত। জাতির ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় সংহতির বিকল্প ছিল না বলেই ইসলামি বিপ্লবীদের ধর্মান্ধ অপশাসন দীর্ঘায়িত হতে পেরেছে।


মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত