সরকারের নীরবতা আছে, জবাবদিহিতা নেই

জোবাইদা নাসরীন
০৮ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সরকারের নীরবতা আছে, জবাবদিহিতা নেই

দেশে নারী নিপীড়ন বাড়ছে নাকি কমছে? এই প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়তো নয়। কারণ এটা কমবেশি সবাই জানে যে, পিতৃতান্ত্রিকতা যতদিন জাঁকালভাবে টিকে থাকবে ততদিন ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন এবং নারীবিদ্বেষ জারি থাকবে। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই নারীর প্রতি সহিংসতা রয়েছে। এখন কথা হলো তা হলে এই তুলনা কেন? এখন কি তবে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন, প্রতিবাদ কিংবা আলোচনা-সমালোচনার কাঠামো পাল্টাচ্ছে?

যদি সাম্প্রতিক সময়ের ধর্ষণের বিষয়গুলোকে আমরা আমলে নিই তা হলে কী দেখতে পাই। কুমিল্লার মুরাদনগরে সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তার পর অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে মারধর করার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ধর্ষণের শিকার নারীকে পরিবারের সামনে বিবস্ত্র অবস্থায় ভিডিও করা হয়। পরে সেটিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়, ধর্ষণের শিকার নারী ধর্ষণ মামলা করেন। পরে এই ঘটনা নিয়ে এত বিষয় ঘটে যে, ধর্ষণের শিকার নারী এবং তার পরিবার বাড়িতে তালা দিয়ে এলাকাছাড়ার চেষ্টা করেছেন বলে গণমাধ?্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

লক্ষ?্য করুন, কী কী ঘটেছিল? সেই ভিডিও ভাইরাল হলে তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ঘটনাকে ঘিরে তাৎক্ষিণক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুক এখন অনেকটাই যেন বিচারালয়। সবাই এখানে বিচারক। সেই বিচারে সবাই হাজির হয় নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক নিয়ে। সেখানে থাকে নানা ধরনের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খানা-খন্দ। সেই বিচারে অনেকেই এই ধর্ষণ ঘিরে নানা ধরনের গল্প, রাজনৈতিক পরিচয়, ধর্মÑ প্রায় সবকিছুই জুড়ে দেন। কারণ ধর্ষণের শিকার নারী ছিলেন হিন্দু। তবে যেসব গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল তার মধ্যে উল্লেখ ছিল যে, এটি একটি পরকীয়ার ঘটনা। বলা হয় যে, ধর্ষণের শিকার নারী হিন্দু এবং যিনি ধর্ষক তিনি মুসলমান। সেই নারীর স্বামী বিদেশ থাকে এবং সেই নারীর সঙ্গে অভিযুক্ত ধর্ষকের পরকীয়া সম্পর্ক রয়েছে। আরেকটি বয়ান হাজির হয় সেখানে যে, এটি দুটি পরিবারের অর্থনৈতিক লেনদেনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। আরও বয়ান আছে, একজন উপদেষ্টা, ওই এলাকায় যার বাড়ি তিনিও ফেসবুকে লিখেছেন যে, ধর্ষক আওয়ামী লীগের। আবার কেউ কেউ বলেছেন, ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয়, তিনি বিএনপির লোক। মনে হচ্ছিল যে, ধর্ষককে রাজনৈতিক পরিচয়ের ঘেরাটোপে ঢুকাতে পারলেই যেন আমরা অনেকটা পথ খুঁজে পাই, ধর্ষকের পরিচয মুছে যায় রাজনীতির প্যাঁচে।

অনেকগুলো প্রশ্ন এখানে যৌক্তিকভাবেই আসে। প্রথমত, কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে কেন আমাদের তার ইতিহাস এবং ধর্ষক তার পরিচিত কিনা, তার সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা সেটি আলোচনায় নিয়ে আসার প্রয়োজন পড়ে? কারণ এর মধ?্য দিয়ে ধর্ষণকে বৈধ করা সহজ হয়। লোকজন ভাবতে থাকে এখানে তা হলে জোরাজুরির কিছু ঘটেনি? কেনই বা ‘পরকীয়া’ গল্প ছড়িয়ে আপনি ধর্ষণের মতো ভয়াবহ সহিংসতাকে বৈধ করছেন? এমনকি তর্কের খাতিরে ধরে নিই সেটি যদি পরকীয়াও হয়ে থাকে তবুও একজন নারী ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারেন। যেখানে বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন নিয়ে আলাপ হচ্ছে সেখানে সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগ আসতে পারে। দ্বিতীয়ত, ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয় কেন জরুরি? কারণ এর মধ?্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ এবং সরকার একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে এই সহিংসতাকে বিচারহীনতার দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে। ধর্ষণকারী আওয়ামী লীগ বা বিএনপি অন?্য কোনো দল সমর্থক হোক না কেন, তার বিচার হওয়াটা জরুরি। তাই কেন ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আসে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় ঘটে, প্রথমত, সে কতটা ক্ষমতাশালী সেটির মাপজোখ করা আর অন?্যটি হলো প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে ঘায়েল করার অস্ত্র হিসেবে ব?্যবহার করা। আর এই দুই মনস্কতার কারণে যেটি হয় তা হলো ধর্ষণের শিকার নারীর বিচার পাওয়া অনেকটাই ঝুলে যায়।

তৃতীয়ত, সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণকে কেন্দ্র করে মিডিয়ায় অনেক ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয় যা অনেক সময়ই শেষ পর্যন্ত ধর্মের স্তরে গিয়ে শেষ হচ্ছে। সেখানে শেষ পর্যন্ত ধর্ষণের বিচারের পরিবর্তে ধর্মীয় বিদ্বেষই বড় হয়ে ওঠে।

শেষ পর্যন্ত যেটি নিয়ে আলোচনা হয় না সেটি হলো ধর্ষণের রাজনৈতিক-অর্থনীতি। এই যে এই পরিবারটি এলাকা ছেড়ে চলে যেতে চায়Ñ সেটিই হলো আসলে রাজনৈতিক-অর্থনীতি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণের মূল জায়গাই হলো জায়গা দখল-বাড়ি দখলের রাজনীতি। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, যখনই সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, পরে সেই পরিবার সেখানে থাকতে পারে না। সেখান থেকে চলে যেতে বাধ?্য হয়। একইদিনে ভোলায়ও আরও একজন নারী নিপীড়নের শিকার হন। সেখানেও বলা হয়েছে, সেটি আসলে তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়েছে। তা হলে প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত করাতে পারলেই সেই নিপীড়ন বৈধ হয়ে যাবে, সেই নিপীড়নের কোনো বিচার হবে না?

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানের বরাতে বিবিসির অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে, এ বছরের ছয় মাসে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেই সংখ্যা ২০২৪ সালের পুরো বছরের চেয়ে অনেক বেশি। এ ছাড়া গত ছয় মাসে দেড়শর বেশি ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০২৪ সালে মোট ৪০১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর এ বছর ছয় মাসের মধ্যেই এ সংখ্যা ৪৪১টি।

এখন ফিরে আসি এই লেখার প্রথম আলাপে। কেন এই প্রশ্ন উঠেছে যে, নারী নিপীড়ন আগের থেকে বেশি হচ্ছে না কম হচ্ছে? এই আলাপের যোগসূত্র অনেক। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বের কাছে পরিচিত নারীর ক্ষমতায়নের মডেল হিসেবে। এই সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই আছেন যারা আগে নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে রাস্তায় দাঁড়াতেন। এই আলাপ এজন্যই জরুরি কারণ নারীর বিরুদ্ধে জনপরিসরে যখন একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল গালি দেয়, তখনও সরকার চুপ ছিল। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব?্যবস্থা গ্রহণ করেনি সরকার। এর পাশাপাশি আমরা দেখেছি যে, যৌন নিপীড়কদের ফুলের মালা দিয়ে থানা থেকে বের করে আনা হচ্ছে যা নারী নিপীড়নকে একভাবে উৎসাহিত করছে।

এখন প্রসঙ্গ হলো নারী ধর্ষণের বিষয়ে সরকারের এই নিশ্চুপতার সঙ্গে আসলে নারী নিপীড়নের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা?

নিশ্চিতভাবেই আছে। নারীর প্রতি অমর্যাদাকর বাৎচিত, বিরামহীনভাবে নারী বিদ্বেষ জনপরিসরে যেভাবে প্রশ্নহীনভাবেই চর্চিত হচ্ছে, সেখানে সরকারের নিশ্চুপতা একভাবে এটিকে আশকারা দেয়। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, নারী নিপীড়ন আগের থেকে বাড়েনি, বরং আগে নারীরা বলত না, এখন বলছে। আমি বিনীতভাবে বলতে চাই, নারীকে বলতে দেওয়ার পরিসর তৈরি করাই তো গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই বলতে পারার সঙ্গে তার বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া অধিক জরুরি। এখন যদি ধর্ষণের ক্ষেত্রেও আগের আমলের প্রসঙ্গ টেনে কথা বলতে হয় তা হলে সরকারের জবাবদিহিতা আর কোথায় থাকল? মনে রাখতে হবে আগের আমল দিয়ে এই আমলের কোনো কিছু বৈধ করা যায় না। বরং উল্টোটাই হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না। বেশি-কমের হিসাব না করে এ কথা একেবারেই দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে, বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতা অত্যন্ত নাজুক।

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে ‘ঘটনা’ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। এগুলোকে যদি আমরা মুরাদনগর, ভোলা কিংবা পটুয়াখালীর ঘটনা হিসেবে দেখি তা হলেই আসলে সমস্যা। এটিকে দেখতে হবে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক আদর্শিক মানদণ্ডে। কেননা যে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ডাক দিল তারা নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নিচ্ছে না? কেন? এত মেয়ে এই আন্দোলনে ছিল তারাও এই ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে না? কেন?

এই ‘কেন’র উত্তর কোথাও নেই এমনটি নয়। তবু মনে রাখবেন নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে যত বেশি আপনারা নিশ্চুপ থাকবেন ততটাই বাড়বে এই সহিংসতা। কারণ নিপীড়নকারী আরও বেশি আশকারা পায়, কারণ সে জেনে গেছে তার বিষয়ে সরকার নিশ্চুপ।


ড. জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়