স্বাস্থ্যসেবা হতে হবে জনকল্যাণমুখী

সফিক চৌধুরী
০৬ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
স্বাস্থ্যসেবা হতে হবে জনকল্যাণমুখী

মাসখানেক ধরে সরকারি হিসাবে করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে, যা আমাদের জন্য দুঃসংবাদ। কিন্তু এই যে করোনা বা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তা মোকাবিলায় সরকারের স্বাস্থ্যসেবা খাত আসলে কতটা প্রস্তুত? বিগত কোভিড-১৯ সময়ের গাফিলতি ও ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও হাসপাতালগুলো আদৌ সতর্ক, সচেতন ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

যুগ যুগ ধরে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে অবকাঠামো ও প্রশিক্ষিত জনশক্তির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা একটা বড় সমস্যা। নব্বই দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো স্বল্প শয্যা থেকে অবস্থানভেদে কোথাও কোথাও ১৫০-২০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত হয়েছে, যাকে আমরা উন্নতি হিসেবেই দেখেছি। কিন্তু অবকাঠামো হলেই তা যে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন নয়, তা আমরা অনুধাবন করতে পারছি বলে মনে হয় না। কেননা দেখা গেছে অবকাঠামো বাড়ানো হলেও জনশক্তি প্রায় জায়গাতেই আগের শয্যা অনুসারেই রয়ে গেছে। আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, দক্ষ জনশক্তির অভাবে সরকারি বড় হাসপাতাল আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে টেকনিশিয়ানের অভাবে বিভিন্ন মেশিন অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে, অ্যাম্বুলেন্স আছে কিন্তু চালক নেই, কোথাও টেকনিশিয়ান আছে অথচ সংশ্লিষ্ট মেশিন নেই; এমন আরও নানা সমস্যা। রোগীরা সেসব যন্ত্রের সেবা নিতে না পেরে বেশি দামে বাইরে পরীক্ষা করাতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাৎ অবকাঠামো বাড়ানো হলেও অনেক ক্ষেত্রেই জনশক্তি বা পরিকাঠামো বাড়ানো হয়নি। এতে আমরা দেখাতে পাচ্ছি, হাসপাতাল ভবন হয়েছে, কিন্তু আদতে সেখানে যথাযথ সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে, হয়তো কোনো হাসপাতালে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, কিন্তু ডিগ্রিধারী নার্স, সাপোর্ট ফোর্স বা আইসিইউ-সিসিইউ সাপোর্ট নেই। এভাবেই চলছে, আর আমরাও নির্বাক ও নির্লিপ্ত!

আমাদের দেশের উচ্চবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তসহ সমাজের একটি বড় অংশ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কয়েক বছর আগে কোভিডের চরম বিস্তারের সময় বাধ্য হয়ে নিজের দেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি চারদিকে এত অব্যবস্থাপনা আর প্রায় ক্ষেত্রেই শুধু নেই নেই দেখে মাথা চাপড়িয়েছে! কিন্তু করোনা-পরবর্তী এত বছর পর এসেও সেই একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি।

করোনাকালের আগে আমাদের নাগরিকদের বড় একটি অংশের শারীরিক যে কোনো সমস্যায় চেষ্টা থাকত যে কোনোভাবে কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরুতে গিয়ে চিকিৎসা করানোর, আর ধনিক শ্রেণিসহ সমাজের প্রভাবশালীদের ভাবনায় ছিল সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড-ইউরোপ-আমেরিকা। কিন্তু দেশে কেন অনেক ক্ষেত্রেই ন্যূনতম চিকিৎসাব্যবস্থা নেই, উপজেলা তো বটেই অনেক জেলা শহরেই কেন আইসিইউ-সিসিইউ সাপোর্ট নেই, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সুবিধা নেই বা কেন সবকিছুতেই বিদেশমুখী হতে হবে তা নিয়ে উচ্চবিত্ত কি মধ্যবিত্ত কেউই ভাবেনি, আর নাগরিকের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যে তার সাংবিধানিক অধিকার তা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হওয়া তো আরও দূরের কাহিনি। বর্তমানে আবার করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট যখন চোখ রাঙাচ্ছে, তখনও পত্রিকায় শিরোনাম দেখছি, আমাদের সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সংকট, অক্সিজেনের স্বল্পতা, করোনার কিট সংকট, ফার্মেসিগুলোর ওষুধ নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতাসহ জবাবদিহিতাহীন বেসরকারি চিকিৎসাসেবা! বিগত সময়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতে এমন নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হওয়ার বদলে আমরা দেখেছি, সমাজের মোটামুটি বিত্তবান অনেক নাগরিকই ব্যস্ত ছিল (যাদের কোনো প্রয়োজনও হয়তো ছিল না) চাল-ডালের মতো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অক্সিজেনের সিলিন্ডার-অক্সিমিটার, একগাদা মাস্ক কিনে বাসায় মজুদ করে রাখতে! যার ফলে সেই সময়ে বাজারে এগুলোর কৃত্রিম সংকট ও মাত্রাতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধিও পেয়েছিল।

পত্রিকার ভাষ্য মতে, এখন আবার করোনার প্রকোপ কিছুটা বাড়ার সংবাদ পেয়ে এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ‘মাস্ক সিন্ডিকেট’। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে মাস্কের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এরই মধ্যে মাস্ক প্রস্তুতকারক কিছু কোম্পানি নাকি বাজারে মাস্কের সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। অনেকেই এখন আগাম মজুদ করে রাখছে, যাতে সংক্রমণ বাড়লে আরও বেশি দামে বিক্রি করা যায়।

এ কথা ঠিক যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জন্যও কোভিড-১৯ ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। স্বাভাবিকভাবে সেখানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল, কিন্তু যে বিচক্ষণতার সঙ্গে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রয়োজন ছিল, তাতে বিরাট ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রথম দিকে স্বাস্থ্য বিভাগের কাজকর্ম দেখে মনে হয়েছে তারা নিজেরাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এ অবস্থায় তারা যেটি করেছে, সেটি অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার মতো। স্বাস্থ্য খাত এমন একটি খাত, যেখানে সামান্য ভুল অসামান্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। পিপিই বিতরণ ও কোভিড পরীক্ষার ক্ষেত্রে তা হয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য বিভাগ কিছুটা নড়েচড়ে বসে এবং তাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো পুরোপুরি স্বচ্ছ না হলেও সতর্কতামূলক ছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা তো অনেকটাই করপোরেট ভাবনায় মোড়া, তাদের ওপর সরকারের তখন বা এখন কোনোকালেই তেমন একটা জোরালো নিয়ন্ত্রণ ছিল বা আছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না। তারা দেশের বিশেষজ্ঞ সরকারি ডাক্তারদের ব্যবহার করে তাদের মুনাফার হার বৃদ্ধি করতেই যেন অধিক তৎপর।

বর্তমানে করোনার নতুন সংক্রমণ বাড়ুক বা না বাড়ুক, আমাদের সতর্ক থাকতেই হবে। যদি কোনো কারণে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে হবে। অন্যথায় বিপদ বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে ভুলে গেলে চলবে না, করোনা মোকাবিলায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই প্রধান এবং অন্যতম সৈনিক। কিন্তু বিগত কোভিড-১৯-এর সময়ে শুরুতে সরকার স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে পারেনি। সময়মতো সর্বোচ্চ মানের পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই), গ্লাভস বা মাস্কের জোগান দিতে পারেনি, আবার সেই সময় এমন খবরও বেরিয়েছিল, মাস্ক যা দিয়েছিল তা নিয়ে খোদ সরকারের মধ্যেই জিজ্ঞাসা ছিল। একটি বিষয় আমাদের স্পষ্ট করে বুঝতে হবে, স্বাস্থ্যকর্মীরা সবচেয়ে বেশি সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে যান। সে জন্য সর্বপ্রথম কর্তব্য হলো, তাদের পর্যাপ্ত প্রটেকশন নিশ্চিত করা।

দেশে ডেঙ্গুতেও প্রতিদিনই অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, অনেকে মারাও যাচ্ছে। সংবাদে প্রকাশ, চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে ডেঙ্গু বেড়েছে তার আগের মাসের চেয়ে দ্বিগুণ হারে। চলতি জুন মাসের প্রথম ১৫ দিন যত রোগী মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তা আগের মাসের আক্রান্তের প্রায় সমান। এবার লক্ষণীয় দিকটি হলো, রাজধানীর বাইরে দেশের অন্যত্র ডেঙ্গু বিস্তারের পরিমাণ অনেক বেশি। রাজধানীতে মশা নিধনে কিছুটা হলেও একটা ব্যবস্থা আছে; কিন্তু ঢাকার বাইরে তা-ও নেই। আর চিকিৎসা পরিকাঠামোর কথা নাই বা বললাম।

ডেঙ্গু প্রতিরোধের দুটি পর্যায়; প্রথমত, ডেঙ্গু যাতে সংক্রমিত না হয়, সে জন্য এর উৎসগুলো ধ্বংস করা। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহিত এডিস মশা নিধন করতে পারলে এই রোগের বিস্তারও রোধ করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা। দুই ক্ষেত্রেই যে আমাদের সীমাহীন ঘাটতি ও দুর্বলতা আছে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। 

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানো, পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৌশলগত অগ্রাধিকার ঠিক করা, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দক্ষতা বাড়ানো, হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীল উদ্যোগ, মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা চালু, মশার ওপর নিয়মিত নজরদারি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গোটা সরকারব্যবস্থার সম্পৃক্ততা এবং জোরালো তদারকি ও নিয়মিত কাজের মূল্যায়ন করা গেলে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করা সম্ভব। ডেঙ্গুর উৎস পুরোপুরি নির্মূল করতে হবে। উপদেশমূলক বার্তায় জনগণ সচেতন না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে সরকারের পক্ষ হতে যারা জনগণকে সচেতন করবেন, তারা নিজেরা কতটা সচেতন, সেটাই একটা প্রশ্ন।

যে কোনো দুর্যোগ-পরবর্তী অভিজ্ঞতা মানুষকে অভিজ্ঞ করে, তা থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়, যাতে করে ভবিষ্যতে এমন যে কোনো দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু বিগত বছরগুলোর ডেঙ্গু ও কোভিড সংকট মোকাবিলায় যে অভিজ্ঞতা আমাদের অর্জিত হয়েছিল, তা থেকে আমরা আদৌ কোনো শিক্ষা নিয়েছি কিনা তা একটি বড় প্রশ্ন। আমরা কি ধরেই নিয়েছি, এভাবেই চলবে আর আর্থিক সংগতি যাদের আছে তারা প্রয়োজনে দেশের বাইরে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে আসবে? কিন্তু এভাবে আর কতদিন?

ভুলে গেলে চলবে না, একটি আদর্শ রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা হতে হবে জনকল্যাণমুখী, সুলভ, সাশ্রয়ী ও বৈষম্যহীন।


সফিক চৌধুরী : বিতার্কিক ও কলাম লেখক