ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে কার লাভ কার ক্ষতি
যুদ্ধ, সংঘর্ষ, মৃত্যু, শরণার্থী- মধ্যপ্রাচ্যের নিয়তি যেন এসব শব্দে গাঁথা। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম উত্তপ্ত সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সৌদি-ইরান, ইরান-ইরাক, প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল এবং ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষে একটিও দিন শান্তিতে কাটেনি।
ইরান ও ইসরায়েল দুই চিরবৈরী রাষ্ট্র সম্প্রতি সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, যার প্রভাব কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বরাজনীতির ভবিষ্যৎকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। দুই দেশের মধ্যে টানা ১২ দিন ধরে চলা হামলা-পাল্টাহামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আপাতত উভয় দেশ যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। গত ২৪ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ট্রাম্প ইসরায়েলকে সতর্ক করেন, যেন তারা ইরানে আর কোনো হামলা না চালায়। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, প্রথমে ইরান হামলা বন্ধ করে এবং ১২ ঘণ্টা পর ইসরায়েলও যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
তবে যুদ্ধবিরতির এই চুক্তি কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ইসরায়েল অভিযোগ করেছে যে, ইরান যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের সামরিক প্রধান ইয়াল জামির বলেছেন, তাদের প্রধান লক্ষ্য এখন আবার গাজায় মনোনিবেশ করা, যেখানে হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এর ফলে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার এই সাম্প্রতিক যুদ্ধ নতুন কিছু নয়। এই সংঘর্ষ বহু দশক ধরে ছায়াযুদ্ধ (ঢ়ৎড়ীু ধিৎ) হিসেবে চলছিল সিরিয়া, লেবানন, গাজা উপত্যকা কিংবা ইয়েমেনের মাটিতে। কিন্তু ২০২৪-২৫ সালে এসে এটি যখন সরাসরি রূপ নেয়, তখন পরিস্থিতি অন্য মাত্রা পায়।
ইসরায়েলের দাবি, ইরান ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, অর্থাৎ পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রায় প্রস্তুত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল একাধিক গোপন ও প্রকাশ্য হামলা চালায় ইরানের পরমাণু স্থাপনায়। পাল্টা ইরান ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জবাব দেয়। সংঘর্ষে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়তে থাকে, ধ্বংস হয় বেসামরিক অবকাঠামো, উদ্বাস্তু হয় হাজারো মানুষ।
এ কথা ঠিক যে, এই যুদ্ধ কোনো হঠাৎ ঝড় নয়, বরং শতবর্ষ পুরনো ভূরাজনৈতিক অভিসন্ধির ফসল। ১৯১৭ সালের সাইক্স-পিকো চুক্তি এবং বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে বিভাজন ও রাজনৈতিক জট তৈরি হয়, তা-ই আজকের মধ্যপ্রাচ্যের দুঃস্বপ্ন। শিয়া-সুন্নি বিভক্তি, কুর্দিদের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা এবং প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল সংঘর্ষ সবই আজকের ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের ভিত্তি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এই যুদ্ধে কার লাভ, কার ক্ষতি হলো এই প্রশ্নটি এখন বিশ্লেষকদের আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। স্বল্প মেয়াদে ইসরায়েল তার কৌশলগত লক্ষ্য কিছুটা পূরণ করেছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে তারা আত্মরক্ষার যুক্তি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তারা শত্রুপক্ষকে আরও ঐক্যবদ্ধ করেছে। হিজবুল্লাহ, হামাস, হুতির মতো গোষ্ঠীগুলো আরও সক্রিয় হয়েছে। তাদের প্রতি ইরানের সমর্থন বেড়েছে। উপরন্তু ইসরায়েলি ভূখণ্ডে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ইরানও এই যুদ্ধে কিছু ‘অদৃশ্য জয়’ অর্জন করেছে। তারা মুসলিম বিশ্বে একটি প্রতিরোধশক্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ইরানের অভ্যন্তরে অর্থনীতি আরও দুর্বল, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর, বেসামরিক নাগরিকদের জীবন আরও বিপন্ন হয়েছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক দিকটি হলো, এই যুদ্ধে প্যালেস্টাইনের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। গাজা অঞ্চল আরও বেশি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ মূলত তাদের ভূমিকে বারুদভাণ্ডারে পরিণত করেছে। তৃতীয় পক্ষের লড়াইয়ের বলি হয়েছে তারা। এবারের যুদ্ধের প্রথম পর্যায়েও উভয় পক্ষ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে একে অপরের সেনাঘাঁটি, পরমাণু স্থাপনা ও বেসামরিক স্থানে আঘাত করে। এই আঘাতে উভয় পক্ষের শতাধিক মানুষ নিহত ও হাজারের বেশি আহত হয়। গাজা, লেবানন ও সিরিয়ায়ও প্রভাব পড়ে।
উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধ থামলেও উত্তেজনা থামেনি। মজার বিষয় হলো, এই যুদ্ধের পর ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র তিন পক্ষই নিজেদের বিজয়ী দাবি করছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পিছিয়ে দিতে পেরেছে; ইসরায়েল দাবি করছে, তারা আঞ্চলিক শত্রু ইরানকে দুর্বল করেছে; আর ইরান বলছে, তারা টিকে আছে এবং শক্তিশালী শত্রুদের পাল্টা জবাব দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, বড় ধরনের যুদ্ধ এড়ানো গেলেও আঞ্চলিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক চাপ এবং মানবিক সংকট তীব্র হয়েছে। ইরানের ভেতরে জাতীয় ঐক্য বৃদ্ধি পেলেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যুদ্ধবিরতির পরও পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত নয়। ইসরায়েল ও ইরান উভয় পক্ষই সতর্ক ও প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে এবং যে কোনো উসকানিতে আবারও সংঘাত শুরু হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য সব সময়ই অবশ্য শক্তিধর দেশগুলোর কাছে এখনও কৌশলগত তেলের গুদাম, অস্ত্রের বাজার এবং রাজনীতির তাসের মাঠ। আমেরিকা ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে তেল রাজনীতিতে আধিপত্য ধরে রাখতে চায়। চীন ও রাশিয়া ইরানকে ঘিরে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে ব্যস্ত। যুদ্ধ যত দীর্ঘ হয়, তত তাদের অস্ত্র বিক্রি, কূটনৈতিক দখল ও রাজনৈতিক মুনাফা নিশ্চিত হয়।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে আমেরিকার ভূমিকা অত্যন্ত জটিল এবং বহুস্তরীয়। ঐতিহ্যগতভাবে ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার মোতায়েন করা হয়েছে এবং মার্কিন সেনাবাহিনী প্যাট্রিয়ট ও থাড (ঞঐঅঅউ) ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসরায়েলের দিকে আসা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সহায়তা করেছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সরাসরি অন্য একটি দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিতে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোর্ডো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনায় বাংকার-বাস্টার বোমা ব্যবহার করে হামলা চালায়। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায়, যদিও এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ট্রাম্প প্রকাশ্যে কূটনীতির কথা বললেও তার বিবৃতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত ছিল। তিনি একদিকে কূটনৈতিক সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন, অন্যদিকে ইসরায়েলের হামলার পর ইরানকে ৬০ দিনের সময়সীমা শেষ হওয়ার কথা বলেন। তিনি ইসরায়েল ও ইরানকে চুক্তিতে আসতে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেন, আবার একই সঙ্গে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করার হুশিয়ারি দেন। এই পরস্পরবিরোধী বার্তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
তবে যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তার প্রচেষ্টায় ১২ দিনের যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছে। তিনি গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ইসরায়েলের সম্মতির কথাও ঘোষণা করেছেন এবং হামাসকে এই চুক্তি মেনে নিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
জি-৭ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি নতুন কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে আলোচনা পুনরায় শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা চলছে বলে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, তবে ইরান এই মুহূর্তে আলোচনার জন্য প্রস্তুত কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের আপাত অবসান হলেও মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা রয়েই গেছে। গাজায় এই মুহূর্তে যে যুদ্ধবিরতি চলছে, তা আপাতত এক শ্বাস ফেলার সুযোগ মাত্র। ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণ বন্ধ করেনি, বরং ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। ইসরায়েলও বারবার বলেছে, তারা চুপ করে বসে থাকবে না। যদি কূটনৈতিক সমাধান না আসে, তবে পরবর্তী সংঘর্ষ হবে আরও ধ্বংসাত্মক, যেখানে শুধু ইরান ও ইসরায়েল নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্য পুড়ে ছাই হতে পারে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মধ্যপ্রাচ্য এখন আর শুধু যুদ্ধের ময়দান নয়, এটি বিশ্বরাজনীতির ল্যাবরেটরি। এখানে নানা গোষ্ঠী, শক্তিধর দেশ, আদর্শ ও স্বার্থ একে অপরকে ঠেকাতে ঠেলছে আগুনে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ তাই শুধুই দুটি দেশের যুদ্ধ নয়, এটি বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর বলপ্রয়োগ ও রাজনৈতিক শোষণের চরম উদাহরণ।
নির্মম সত্যিটা হচ্ছে- এই যুদ্ধে কারও প্রকৃত জয় নেই। শুধু ক্ষতি, শুধুই মৃত্যু। লাভ হয় কেবল অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের, ভূরাজনৈতিক দানবদের এবং ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের রচয়িতাদের।
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক