উচ্চশিক্ষায় সক্ষমতা বৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি দিলে নিরক্ষরতার হার কমে যাওয়া, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের প্রবেশ বৃদ্ধি, নানামুখী গবেষণায় শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত হওয়ার মতো অনেক আশাবাদী হওয়ার সংবাদ রয়েছে। পাশাপাশি হতাশ হতে হয় কর্মস্থলের উপযুক্ত দক্ষ কর্মী না পাওয়ায়। সনদনির্ভর শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষায় প্রচুরসংখ্যক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ক্ষেত্রবিশেষে শুধুই একটা সনদে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা পাস করে বের হওয়ার পর তারা যখন কর্মস্থলে প্রবেশ করে, প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে প্রায় প্রত্যেককেই নানামুখী সমস্যার মুখে পড়তে হয়। এ জন্যই বেশির ভাগ শিক্ষক ও শিক্ষাবোদ্ধা প্রশ্ন করেছেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য কোনটি বেশি জরুরি সনদ তথা সার্টিফিকেট (ঈবৎঃরভরপধঃব), নাকি সক্ষমতা তথা স্কিল (ঝশরষষ)?
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় নানা সময়ে বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে সেখানে আড়ালে থেকে যায় স্কিল ডেভেলপমেন্ট কোর্সগুলো। আজকের প্রতিযোগিতামূলক ও দ্রুত পরিবর্তনশীল চাকরির বাজারে ‘শিক্ষা বনাম দক্ষতা’ নিয়ে বিতর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষত যারা বিবিএ, এমবিএ কিংবা অন্যান্য উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি অর্জন করেছেন কিন্তু চাকরির নিশ্চয়তা পাননি, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে একটি প্রশ্ন বারবার উঠে আসে সার্টিফিকেট কি যথেষ্ট? শিক্ষার সার্টিফিকেট নিঃসন্দেহে একজন মানুষের জ্ঞানার্জনের প্রামাণ্য দলিল, তা তাকে একজন সচেতন, সভ্য ও চিন্তাশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে; কিন্তু একে একমাত্র চাকরির চাবিকাঠি ভাবা বোধ হয় আজ আর যথার্থ নয়।
অবশ্যই কিছু পেশা রয়েছে যেখানে সার্টিফিকেট ছাড়া এগোনোর কোনো পথ নেই; যেমন- ডাক্তার, প্রকৌশলী কিংবা আইনজীবী হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ও অনুমোদন অপরিহার্য। এই সার্টিফিকেট কেবল পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ নয়, বরং সেই ব্যক্তির নির্দিষ্ট বিষয়ে গভীরতা, ধৈর্য ও দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলনেরও প্রতিফলন। একইভাবে, অনেক বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনের চাকরি কিংবা পদোন্নতির ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত।
তবে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের মূল্যায়নব্যবস্থায়ও এক নবতর দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা হয়েছে। বর্তমান সময়ের নিয়োগকর্তারা শুধু সার্টিফিকেট দেখে সিদ্ধান্ত নেন না। বরং একজন প্রার্থী বাস্তব পরিস্থিতিতে কতটা কার্যকরভাবে কাজ করতে পারেন, সমস্যা সমাধানে কতটা দক্ষ, নতুন প্রযুক্তি বা কৌশল কত দ্রুত রপ্ত করতে পারেন এসব বিষয় এখন অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্কিল বা ব্যবহারিক দক্ষতা প্রমাণ করে দিচ্ছে, কে আসলে একজন কার্যকর কর্মী।
ধরা যাক একজন প্রোগ্রামারের কথা। তার হাতে হয়তো কম্পিউটার সায়েন্সের সার্টিফিকেট রয়েছে, কিন্তু যদি সে জাভা বা পাইথনসহ আধুনিক প্রোগ্রামিং ভাষায় দক্ষ না হয়, তাহলে সে আজকের চাকরির বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। আবার ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে যদি একজন বিপণনকারী সার্টিফিকেট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া অ্যানালিটিকস কিংবা গুগল অ্যাডসের ব্যবহার না জানেন, তাহলে প্রতিষ্ঠান তার ওপর আস্থা রাখতে পারবে না।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আধুনিক যুগের কর্মক্ষেত্র প্রযুক্তিনির্ভর, উদ্ভাবনপ্রবণ এবং ফলাফলনির্ভর। ফলে আজকের দিনে শিক্ষাগত যোগ্যতা কেবল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, বাস্তব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা হলো তার ওপর নির্মিত ভবনের রূপ। এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে অনেক প্রতিষ্ঠান আজ স্কিলভিত্তিক নিয়োগে মনোযোগ দিচ্ছে। এমনকি বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও আজ প্রথাগত ডিগ্রি ছাড়াই দক্ষ প্রার্থীকে নিয়োগ দিচ্ছে।
তাই বলা চলে, শিক্ষা ও দক্ষতা- এ দুটি হাত ধরাধরি করেই এগিয়ে যেতে পারে। সার্টিফিকেট মানুষকে সভ্য করে, যুক্তিশীল করে, অথচ দক্ষতা তাকে বাস্তবে সফল করে তোলে। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে বেছে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং শিক্ষার আলোকেই দক্ষতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করতে হবে।
আজকের তরুণদের প্রতি বার্তা হলো- শুধু ডিগ্রির ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। প্রতিনিয়ত শেখা, আপডেট থাকা, বাস্তব দক্ষতা অর্জন করা এবং নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতাই আপনাকে কর্মজীবনে এগিয়ে দেবে। আর এই শিক্ষাই আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে যেখানে কেবল ডিগ্রি নয়, বরং সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও বাস্তবতা হবে সাফল্যের আসল চাবিকাঠি।
বিবিএ, এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন কিন্তু বেকার। আগেই বলেছি, এডুকেশন (সার্টিফিকেট) মানুষকে সভ্য করে কিন্তু চাকরি দেয় না। চাকরি দেয় স্কিল, নির্দিষ্ট পেশা ব্যতীত, যেমন ডাক্তার, প্রকৌশলী বা আইনজীবী ইত্যাদি। এটি আপনার শিক্ষাগত পটভূমি এবং একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আপনার গভীরতা প্রমাণ করে। অনেক ক্ষেত্রে ভালো বেতনের চাকরি এবং পদোন্নতির জন্যও সার্টিফিকেট একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়।
অন্যদিকে, আধুনিক কর্মক্ষেত্রের প্রবণতা স্কিলের দিকে ঝুঁঁকেছে। অনেক নিয়োগকর্তা এখন প্রার্থীর ব্যবহারিক দক্ষতা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে বেশি প্রাধান্য দেন। তাদের মতে, একটি সার্টিফিকেট কেবল কাগজের টুকরো, কিন্তু বাস্তব দক্ষতা আপনাকে কর্মক্ষেত্রে সফল হতে সাহায্য করে। দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির যুগে নতুন দক্ষতা অর্জন এবং সেগুলোর প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
সার্টিফিকেট ও স্কিল উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভালো সার্টিফিকেট আপনাকে চাকরির বাজারে প্রবেশের সুযোগ করে দিতে পারে, কিন্তু আপনার দক্ষতা আপনাকে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে এবং কর্মজীবনে সফল হতে সাহায্য করবে। সুতরাং একজন ব্যক্তির উচিত তার একাডেমিক সার্টিফিকেট অর্জনের পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতাও বাড়ানো। উদাহরণস্বরূপ, কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি (সার্টিফিকেট) অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা (স্কিল) একজন শিক্ষার্থীকে চাকরির বাজারে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। সার্টিফিকেট একটি ভিত্তি তৈরি করে, কিন্তু ক্রমাগত নতুন দক্ষতা অর্জনই আপনাকে কর্মজীবনে এগিয়ে রাখবে। পরিশেষে বলা যায়, সার্টিফিকেট এবং স্কিল একে অপরের পরিপূরক। একটি সুষম সমন্বয়ই আপনাকে একটি সফল কর্মজীবনের দিকে নিয়ে যাবে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন সামনে রেখে প্রয়োজনীয় স্কিল ডেভলপমেন্ট কোর্স খোলা যেতে পারে। সেখানে শিক্ষার্থীরা পঠিত বিষয়ের সঙ্গে এই কোর্সগুলোকে সম্পূরক হিসেবে পড়বে। আর সেখানে স্থানীয় ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যুক্ত করা যেতে পারে। যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী কিংবা সাতক্ষীরার মতো আমের এলাকাগুলোতে এমন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে, যা আম সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করে। এতে করে ফল হিসেবে আমের সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে অপচয় যেমন বন্ধ হবে, তেমনি পুষ্টির চাহিদা পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একইভাবেই বগুড়ার আলু, বিভিন্ন অঞ্চলের শীতের সবজি, নরসিংদীর লটকন, টাঙ্গাইলের আনারস, গাজীপুরের কাঁঠাল, দিনাজপুর, রাজশাহী ও ঈশ্বরদীর লিচু সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতেই পারে।
বাস্তবে আমাদের সামনে যেটি অনিবার্যভাবে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় তা হলো- শিক্ষার সার্টিফিকেট এবং ব্যবহারিক দক্ষতা, উভয়ই কর্মজীবনের জন্য অপরিহার্য। কেউ কারও বিকল্প নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। একটি ভালো সার্টিফিকেট যেমন আপনাকে একটি সম্ভাবনার দরজার কাছে পৌঁছে দিতে পারে, তেমনি আপনার বাস্তব দক্ষতা সেই দরজাটি খুলে ভেতরে প্রবেশ করার সাহস, যোগ্যতা ও সক্ষমতা জোগায়। এই যুগের কর্মপ্রবাহের জটিল, গতিশীল এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিসরে টিকে থাকতে চাইলে দুটির সমন্বয়েই গড়ে তুলতে হবে একটি শক্তিশালী পেশাগত পরিচয়।
সার্টিফিকেট, বিশেষত উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি একটি কাঠামোবদ্ধ জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি ব্যক্তির অধ্যবসায়, ধারাবাহিকতা এবং নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি মনোযোগের একটি নিদর্শন। ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত একটি সার্টিফিকেট প্রার্থীকে চাকরির বাজারে প্রাথমিক সুবিধা এনে দেয়, অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারের টেবিল পর্যন্ত নিয়ে যায়। তবে সেখানে বসে নিজেকে প্রমাণ করার জায়গাটি তখন দখল করে বাস্তব দক্ষতা, ব্যবহারিক জ্ঞান ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা।
বর্তমান সময়ের বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তি ও অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে একজন পেশাজীবীর হতে হবে ‘লার্নার ফর লাইফ’ অর্থাৎ আজ যা শিখলাম, কাল তা পুরনো হয়ে যেতে পারে। তাই নিরন্তর শেখা, আত্ম-উন্নয়ন এবং নতুন স্কিল আয়ত্ত করার মানসিকতা গড়তে হবে। সার্টিফিকেট একটি ভিত্তি দেয়, কিন্তু সেই ভিত্তির ওপর ভবন নির্মাণের উপাদান হয় অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
তাই আজকের তরুণদের প্রতি পরামর্শ, শুধু ডিগ্রি অর্জন করে থেমে যাওয়া যাবে না। যতই ভালো ডিগ্রি হোক, সেটি যদি সময়োপযোগী দক্ষতার সঙ্গে সংগতি না রাখে, তবে তা কর্মক্ষেত্রে দুর্বলতা হিসেবে গণ্য হবে। অন্যদিকে একজন দক্ষ কিন্তু ডিগ্রিহীন ব্যক্তি অনেক সময় কর্মে দক্ষ হলেও পদোন্নতি বা নীতিগত মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েন। এ কারণে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সার্টিফিকেট অর্জনের বাইরেও বাস্তব জীবনে সেই জ্ঞানের প্রয়োগ শেখা। কর্মজীবনে সফলতা তখনই আসে, যখন জ্ঞান ও দক্ষতা এক সুতোয় গাঁথা হয়।
আবুল হাসনাত মোহা. শামীম : অধ্যাপক ও গবেষক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়