উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমনে এত তাড়া কেন
অনেক আগে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যেত। এরপর ধনাঢ্য পরিবারের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে যাওয়া শুরু করল। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে যারা একান্তই বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যেতে পারছে না, তারা ছাড়া সব মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাই বিদেশে পড়তে যেতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ধনাঢ্যরা তো আছেই, সেই সঙ্গে উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরাও যে কোনো উপায়ে দেশের বাইরে পড়তে যেতে চাচ্ছে। মা-বাবারা তাদের জমানো অর্থ ভেঙে বা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে সন্তানদের বর্তমানে বিদেশে পড়াতে আগ্রহী হচ্ছেন। এর কারণ কী তাই আমরা এ লেখায় খুঁজব।
দেশে বছর বছর সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। তাতেও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া কমছে না। বরং গত ১০ বছরে বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী ৫৫টি দেশে পড়াশোনার জন্য গেছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ১৫১ এবং ২০২১ সালে ছিল ৪৪ হাজার ৩৩৮।
দেখা যায়, ২০১৩ সালে বিদেশে গিয়েছিল ২৪ হাজার ১১২ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ইউনেসকোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি, ৮ হাজার ৫২৪ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্য (৬ হাজার ৫৮৬ জন), আর তৃতীয় কানাডা (৫ হাজার ৮৩৫ জন)। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থী বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের ব্যালান্স অব পেমেন্টস উপবিভাগের প্রতিবেদনেও। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বিদেশে উচ্চশিক্ষা বাবদ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো টাকার পরিমাণ প্রতিবছর বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে ১৫ কোটি ৪ লাখ ডলার। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
বিদেশে কেন এত শিক্ষার্থী পড়তে যাচ্ছে
১. অনেকে মনে করে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোয়ালিটি এডুকেশন দেয় না।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
২. দেশে কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ। বেকারত্বের হার ক্রমশ বাড়ছে।
৩. ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা।
৪. দিন দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া।
৫. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
৬. বিদেশে মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তি ও খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ।
৭. বর্তমানে ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিদেশে পড়তে যাওয়া সহজ। বৃত্তি ও ফান্ডিংয়ের (তহবিল) সুযোগ বাড়ছে বলে স্নাতক পর্যায় থেকেই অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা শুরু করার আগ্রহ দেখাচ্ছে। অনেকে মাস্টার্স বা পিএইচডি করে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমাচ্ছে। দেখা যায়, বিদেশে পড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সচরাচর ইংরেজিভাষী দেশগুলোকে প্রাধান্য দেয়। তাই প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা আর অস্ট্রেলিয়ায় অনেক শিক্ষার্থী পড়তে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সুযোগ বাড়ার কারণে সংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে কানাডায় সম্প্রতি নিয়মকানুন কিছুটা কঠিন হয়ে যাওয়ার ফলে সংখ্যা কমছে। অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে সব সময়ই শিক্ষার্থীদের সুযোগ অনেক বেশি থাকে, তাই বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সংখ্যায় থাকে বেশি। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে সংখ্যার হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল অষ্টম। এর আগের বছর বাংলাদেশ ছিল ১৩তম। যুক্তরাষ্ট্রে একেক সময় একেক ধারা দেখা যায়। সেই ধারাবাহিকতায় বোঝাই যাচ্ছিল যে নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসার পর কিছু পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব, সাম্প্রতিক সময়ে যেমন কিছু বিধিনিষেধ চোখে পড়ছে। ২০২৫ সালের মে মাসের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবসম্পন্ন আবেদনকারীদের ভিসা রোধে ট্রাম্প প্রশাসন সাময়িকভাবে স্টুডেন্ট ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্থগিত করে। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, তারা আবারও ‘এফ’, ‘এম’ ও ‘জে’ ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চালু করবে। তবে এবার আবেদনকারীদের সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্টগুলো সর্বজনীন রাখতে হবে, যাতে কঠোরভাবে তাদের মনোভাব যাচাই করা যায়।
৮. আজকাল বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বিদেশে স্থায়ীভাবে থাকতে ও নাগরিকত্ব লাভে আগ্রহী।
প্রশ্ন হলো, এভাবে আর কতদিন চলবে? একটি দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কেন উচ্চশিক্ষার জন্য অন্য দেশে গমনে আগ্রহী হবে, যেখানে আমাদের দেশে এখন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে? তাই এখন সময় উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবিদদের এ নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা করার। যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরি, ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটি কোলাবরেশন, নতুন রিসার্চের ক্ষেত্র তৈরি, তরুণ মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ, সেই সঙ্গে বহু বছরের অভিজ্ঞ পণ্ডিতদের তাদের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সুযোগ করে দিতে হবে। বর্তমান যুগে স্টুডেন্টদের পড়াশোনায় আগ্রহী করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস/লাইব্রেরি/ক্যান্টিনের ব্যাপক উন্নয়ন/আধুনিকায়ন দরকার, মান্ধাতা আমলের অবকাঠমো দিয়ে বর্তমান আধুনিক তরুণদের ধরে রাখা কঠিন। শিক্ষার্থীদের পাস করার সঙ্গে সঙ্গে কাজের সংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি। এ বিষয়টি সমাধান করার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গবেষণা করতে পারে। বর্তমান শিক্ষার্থীদের দেশের সব কাজকে মূল্যায়ন করা শিখতে হবে। শুধু সরকারি-বেসরকারি চাকরি বা কিছু কমন সাবজেক্টে পড়া তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। দেশের বাইরে গেলে আমাদের শিক্ষার্থীরাই নানা ধরনের কাজ করে থাকে, তাহলে দেশে করতে কুণ্ঠা কেন? শিক্ষার্থীদের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ধরে রাখতে হলে দেশের উচ্চশিক্ষার খোলনলচে পরিবর্তন করা ছাড়া বোধহয় আর উপায় নেই।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক