বিশ্ব এখন যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ

চিররঞ্জন সরকার
৩০ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বিশ্ব এখন যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ

বিশ্ব এখন যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। এ কথা আজ আর নিছক কোনো রাজনৈতিক রসিকতা নয়, বরং এক নির্মম বাস্তবতা। একটি পশ্চিম এশীয় সংবাদমাধ্যম শিরোনাম করেছিল ‘বিশ্ব এখন যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ, আমেরিকার দৌলতে’। শিরোনামটি নিখুঁত; তীব্র কটাক্ষ আর নির্মম সত্যের এমন মিশ্রণ সচরাচর দেখা যায় না। এই একটি বাক্য যেন পুরো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার শবদেহের ওপর ছুড়ে দেওয়া একটি অগ্নিগর্ভ সতর্কবাণী যুদ্ধ এখন আর ব্যতিক্রম নয়, বরং নিয়ম। ‘নিরাপত্তা’র নামে এই নিয়মকে প্রতিদিন নতুন করে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।

যখন মার্কিন বোমারু বিমান ইরানের পরমাণু স্থাপনার ওপর হামলা চালায়, সেই শব্দ কেবল পারস্য উপসাগরের আকাশে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা প্রতিধ্বনিত হয় পৃথিবীজুড়ে। সেই শব্দের মাঝে লুকিয়ে থাকে এক অঘোষিত ঘোষণা আজকের বিশ্বে যে যত শক্তিধর, তার হাতেই ন্যায়ের সংজ্ঞা, তার হাতেই পরমাণুর ভাগ্য। ইরান বারবার বলেছেÑ তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের জন্য। তারা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার নিয়ম মেনেই গবেষণা চালায়। তবুও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এটি বিশ্বাস করে না। কেন করে না? কারণ, তাদের ভয় হয়। এই ভয়ই এখন সামরিক হস্তক্ষেপের মূর্তিমান যুক্তি হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে আজ যে কোনো দেশের ওপর বোমা ফেলাও ‘স্বাভাবিক’।

এ যেন বিশ্বরাজনীতির এক বিকৃত পাঠশালা, যেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো মুখে নিরস্ত্রীকরণের কথা বললেও নিজেরা পরমাণু অস্ত্র মজুদ করে হাজার হাজার। তারা গড়ে তোলে বিমানবাহী রণতরি, মহাকাশভিত্তিক অস্ত্রব্যবস্থা, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধব্যবস্থা। কিন্তু অন্য কোনো রাষ্ট্র যদি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান গবেষণা করে, তাকে বলা হয় হুমকি। কোনো দেশ যদি পরমাণুবিজ্ঞানী নিয়োগ দেয়, সেটিকে দেখা হয় যুদ্ধের পূর্বাভাস হিসেবে। কোনো জনগোষ্ঠী যদি স্বাধীনতার প্রশ্ন তোলে, সেটিকে ঘোষণা করা হয় জঙ্গি কার্যকলাপ। এটা ঠিক যেন প্রাসাদের প্রহরীর হাতে বন্দুক থাকলে তা ‘নিরাপত্তা’ আর এক ভিখারির পকেটে রক্তমাখা ছুরি থাকলে তাকে বলা হয় চোর, ডাকাত বা খুনি এমনকি তাকে হত্যা করাও বৈধ হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে ঠিক করে কাকে প্রহরী বলা হবে, আর কাকে ডাকাত? এই প্রশ্নের উত্তর যদি হয় ‘ক্ষমতা’, তাহলে বুঝতে হবে আমরা একটি পীড়িত ন্যায়বোধের মধ্যে বাস করছি। আর যদি উত্তর হয় ‘শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার’, তাহলে আমাদের এই আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার ভিত্তিই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

আজ সার্বভৌমত্বও আর নিশ্চিত অধিকার নয় সেটি শর্তাধীন। রাষ্ট্র হিসেবে আপনার অস্তিত্ব, সিদ্ধান্ত, এমনকি প্রতিরক্ষানীতিও অনুমোদিত হতে হবে জাতিসংঘের পাঁচ ‘স্থায়ী’ সদস্যের কাছ থেকে যারা নিজেদের ক্ষমতার উৎস হিসেবে তুলে ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পুরনো দাবি। তাহলে কি এই বিশ্ব চিরকাল সেই পুরনো ইতিহাসের কাছে বন্দি হয়ে থাকবে? যদি নতুন কোনো রাষ্ট্র অস্ত্র রাখতে চায়, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়, তাহলে কি তাকে আগেভাগেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হবে? ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা এরা সবাই এই বৈশ্বিক দ্বিচারিতার শিকার। উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র ভয়ংকর, কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন ‘শান্তির অংশ’। রাশিয়া প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বাড়ালে সেটি হয় আগ্রাসনের প্রমাণ, অথচ যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালে সামরিক খাতে খরচ করেছে প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলার এবং তা ‘প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ’।

ভারত-পাকিস্তান যখন পরমাণু অস্ত্রধারী হলো, তখনও পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে তেমন প্রতিক্রিয়া আসেনি। বরং চুপচাপ এক নীরব অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস করতে প্রস্তুত ছিল। ইরান বা সিরিয়া সেই পথ নেয়নি তাই তাদের জন্য বরাদ্দ কেবল একটিই নীতি : চূর্ণ করে দাও। ট্রাম্পের আমলে এই ধ্রুপদি নিপীড়ন আরও সরাসরি রূপ পায়। কূটনীতি বা সহনশীলতা নয়, বরং এক রুক্ষ আগ্রাসন। ট্রাম্প কংগ্রেস বা প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের তোয়াক্কা না করেই হত্যা করেন ইরানের জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে। বোমা ফেলতে সময় নেন না। কারণ, তার কাছে প্রধান লক্ষ্য ইসরায়েলের সন্তুষ্টি এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ।

তার প্রশাসনের অভ্যন্তরেও এই আগ্রাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল নিয়ে দ্বিধা ছিল। কিন্তু তবু সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি এখন ভয়। যদি ইরান প্রতিশোধ নেয় হরমুজ প্রণালিতে, যদি তারা তেলবাহী ট্যাংকার আটকায়, তাহলে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয় গোটা বিশ্বের জ্বালানির বাজার ধসে পড়বে। দামের উল্লম্ফন হবে মারাত্মক। আর এর চাপ গিয়ে পড়বে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঘাড়ে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ চালাবে, আর দাম চুকাবে সুদান, হন্ডুরাস কিংবা ফিলিস্তিন।

কিন্তু সমস্যা শুধু সামরিক আগ্রাসনেই সীমাবদ্ধ নয় যুদ্ধজয়ের নতুন ক্ষেত্র আজ মানসিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর। কারা সন্ত্রাসী আর কারা ‘বন্ধু’, তা স্থির করে ওয়াশিংটনের রাজনীতি। গাজার শিশুদের ওপর যখন বোমা পড়ে, তখন সেটা আত্মরক্ষা। ফিলিস্তিনি যদি পাথর ছোড়ে, তখন তা জঙ্গিবাদ। সিরিয়ার কোনো গোষ্ঠী প্রতিরোধ গড়ে তুললে তারা জঙ্গি, আর ইউক্রেনের মিলিশিয়া যদি একই কাজ করে, তারা ‘স্বাধীনতাযোদ্ধা’। এমন এক বিকৃত নৈতিকতা আমরা সৃষ্টি করেছি, যেখানে কিছু রাষ্ট্রের হাতে আছে ‘স্বর্গের চাবি’, বাকিদের জন্য বরাদ্দ নরক। সেই চাবি আজ মানবাধিকারের প্রতীক নয় বরং যুদ্ধের লাইসেন্স।

তাই যখন কেউ বলে, ‘বিশ্ব এখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত’, তখন বুঝতে হবেÑ এই যুদ্ধ মানুষের জন্য নয়, এই যুদ্ধ অস্ত্র ব্যবসার জন্য, আধিপত্যের জন্য। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা ফেলার পর বিশ্ব চেয়েছিল আর যেন না হয়। কিন্তু সেই শিক্ষা রাষ্ট্রনায়কদের কানে পৌঁছায়নি। বরং তারা বুঝে গেছে, ভয় দেখানোই শক্তির স্থায়িত্বের গ্যারান্টি। আজকের বিশ্বব্যবস্থায় অস্ত্রই শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এই ব্যবস্থা নিরস্ত্রীকরণকে বিশ্বাস করে নাÑ বরং অস্ত্রধারীদের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করে।

তাহলে প্রশ্ন হলো পৃথিবীর বাকি রাষ্ট্রগুলো কি চিরকাল এই নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকবে? তাদের কি কোনো অধিকার নেই আত্মরক্ষার? যদি আমেরিকা, রাশিয়া, চীন পরমাণু মজুদ করতে পারে, তাহলে কেন ইরান নয়? কেন বাংলাদেশ নয়? কেন ব্রাজিল নয়? অবশ্যই, আমরা চাই না পরমাণু অস্ত্র প্রতিটি দেশে ছড়িয়ে পড়ুক। কারণ অস্ত্র দিয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করা যায় না। কিন্তু আমরা এটাও চাই না, একটা বৈষম্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এমনভাবে চলুক, যেখানে শক্তিধরদের হাতে থাকুক সব সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রণ।

‘নিরাপত্তা’ শব্দটির অর্থ আজ কেবল সামরিক আধিপত্যে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এটি যেন এখন শক্তিশালীদের একচেটিয়া দাবিতে পরিণত হয়েছে যার অর্থ, যে বেশি অস্ত্র রাখে, সেই বেশি নিরাপদ। অথচ প্রকৃত নিরাপত্তা আসে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও সহযোগিতা থেকে। এটি আসে স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল কূটনীতি থেকে, যেখানে ছোট দেশগুলো কেবল দাবানলের উপকরণ হয়ে পড়ে না, বরং নিজের ভবিষ্যৎ গঠনের অংশীদার হতে পারে।

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিকস, ওআইসিÑ এদের যদি এখনও আত্মমর্যাদা থাকে, তাহলে তাদের এখনই মুখ খুলতে হবে। না হলে তারা নিজেরাই ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে।

কারণ এই যে চুপিসারে বোমাবর্ষণ, এই সাজানো ভয়, এই যান্ত্রিক কূটনীতির অজুহাত সবই আসলে মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে চলমান একটি সংগঠিত অপরাধ। এটি শুধু ইরানের বিষয় নয়, শুধু গাজা, বাগদাদ বা দামেস্ক নয় এটি গোটা বিশ্বব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। আজ যে নীতি ইরানের ওপর প্রয়োগ হচ্ছে, কাল তা আরেকটি দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর নামবে। যদি এই রূপান্তরিত উপনিবেশবাদের প্রতিবাদ আজ না করা হয়, তাহলে কাল আমরা সবাই তার শিকার হব কেউ অস্ত্রের দ্বারা, কেউ অনাহারে, কেউ জাতিসত্তার নিশ্চিহ্নতায়।

এই মুহূর্তে আমাদের বড় প্রয়োজন বিচারহীন ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত মনুষ্যসমাজের প্রতিবাদ। এমন এক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ, যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি চালিত হবে হুমকির ভাষায় নয়, সংলাপ, সহাবস্থান এবং দায়িত্বের বোধে। এমন এক পৃথিবী গঠন করতে হবে, যেখানে রাষ্ট্রীয় অহংকার নয়, বরং বৈশ্বিক মানবতার স্বার্থই হবে সবচেয়ে বড় পরিচয়।

নইলে এই আগ্রাসন, এই আগ্রাসনের প্রণয়ন, অনুমোদন ও নীরবতা সবই ইতিহাসে অমার্জনীয় পাপ হিসেবে থেকে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের ব্যর্থতা হয়ে থাকবে এই প্রশ্নÑ তোমরা তখন কী করছিলে, যখন পৃথিবীর ওপর যুদ্ধ নামিয়ে আনা হচ্ছিল?

কারণ সত্য একটাই বিশ্ব এখন যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু মানুষের জন্য নয়!


চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক