দেশ না হোক মবের মুলুক
বিজয়ের সাইড ইফেক্টের মতো ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশে গজবের মতো নাজিল হয়েছে মবপাণ্ডামি। শুরুতে কেউ কেউ একে মব জাস্টিস বলা শুরু করেছিলেন। লেখালেখি, টক শোসহ পেশাগত ও ব্যক্তিগত সীমানায় বলে আসছি, মব শব্দের সঙ্গে জাস্টিস শব্দটি যায় না। তা জাস্টিস শব্দের অবমাননা। কারণ মব একটি চরম অন্যায়, অবিচার। আরও সোজা করে বললে, বদমায়েশি-পাণ্ডামি। কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস শুরু থেকেই বলে এসেছেন, বিচারের আগে এ ধরনের বিচার যেন করা না হয়। কিন্তু তেমন গ্রাহ্য হচ্ছিল না তার আহ্বান। একপর্যায়ে মবের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এতে একটা ভয় তৈরি হয় মববাজদের মধ্যে। দিন কয়েকের মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে আবার মবের তেজ বাড়তে থাকলে দেশের কয়েক জায়গায় অ্যাকশনে যায় সেনাবাহিনী। এতে মবের লাগামে খানিকটা টান পড়ে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার ঘটনায় আবার মবের ঢোলে বাড়ি পড়ার নমুনা দেখা দেওয়ায় দ্রুত পদক্ষেপে গেছে সেনাবাহিনী।
মব তৈরি করে নুরুল হুদাকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। সেই সঙ্গে আবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর শক্ত অবস্থানের কথা। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) বিজ্ঞপ্তিটি এ ক্ষেত্রে একদিকে অত্যন্ত তথ্যমূলক, আরেকদিকে দ্রষ্টব্য করে রাখার মতো। এতে বলা হয়, সাবেক সিইসির বিরুদ্ধে মামলা থাকায় বিষয়টি সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশকে অবহিত করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও তাদের সামনেই তাকে লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে সাবেক সিইসিকে ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ঘটনাটি সংশ্লিষ্ট সেনা ক্যাম্পের নজরে এলে দ্রুত অভিযানে নামে সেনাবাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ জুন এ ঘটনায় মব সৃষ্টিকারী হিসেবে অভিযুক্ত মো. হানিফ নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরই মধ্যে অন্য জড়িতদের শনাক্তকরণ ও গ্রেপ্তারের কার্যক্রম চলমান।
বিজ্ঞপ্তির প্রতিটি শব্দসহ বাক্যগুলো বিশ্লেষণযোগ্য। কেউ উপলব্ধিতে না আনলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গেও যে এটা ঘটবে না, কেউ তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। ভোটের ইতিহাসে কে এম নুরুল হুদা অবশ্যই একটি কলঙ্কিত নাম। তার অপরাধের মাত্রাদৃষ্টে বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। সেটা করার আইন আছে। ডিম মেরে, জুতা দিয়ে কয়েক ঘা বাড়ি দিয়ে, জুতার মালা পরিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া মোটেই আইন নয়। টানা দেড় দশকে যে মহল বা পরিবার আক্রান্ত হয়েছে সে প্রতিশোধ নিতে চাইবে। সুযোগ পেলে শোধ নেবেও। তাকে আইনের শাসনের কথা বলে থামানো কঠিন। এ কঠিন কাজটি সরকারকে করতেই হবে। মবের সামনে সরকার হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। ভিকটিমের আবেগ থাকবে, কিন্তু সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে আইন দিয়ে। নুরুল হুদার বিচার চাই বলে মব সমর্থনযোগ্য নয়। কথায় কিন্তু কথা এসে যায়। নুরুল হুদার পাপের স্কোর সবচেয়ে বেশি থাকলেও সরকার নয় মাসেও কোনো আইনি পথে যায়নি। বিএনপির মামলা করার আগ পর্যন্ত তেমন পদক্ষেপও নেয়নি। তাই কারও কারও মতে, নুরুল হুদার গলায় যে জুতার মালা পরানো হয়েছে এবং তার গালে যে জুতোর বাড়ি পড়েছে এটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপরও পড়েছে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের ভেরিফায়েড পেজ থেকে দেওয়া বিবৃতিটি বেশ ইতিবাচক। এতে তিনি বলেছেন, এই বিচার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
মানুষ আশায় বাঁচে। প্রধান উপদেষ্টার কথায় এ ধরনের দুষ্কর্মের লোকদের আইনি বিচারের অপেক্ষা করা যেতেই পারে। কিন্তু বেলায় বেলায় সময় অনেক গড়িয়ে যাচ্ছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আরও কঠোর হাতে মবের লেজে বাড়ি পড়লে আজ অবস্থা এতটা গড়ায় না। মব তৈরি করে হামলা, অবমাননা, নির্যাতনের সংস্কৃতির তেজ এ পর্যন্ত আসে না। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। অভ্যুত্থানের ১০ মাস অতিবাহিত হলেও এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার মাঝে কার্যকর ভাব নেই। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি থাকলেও নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে। মব-সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের এই ব্যর্থতা গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় সারলে চলবে না, অবশ্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশে ’১৪, ’১৮ ও ’২৪-এর প্রহসনের নির্বাচনের পেছনে যারা ছিলেন, তাদের প্রত্যেকেরই এসব নির্বাচনের ও গণতন্ত্র ধ্বংসের দায় আছে এবং তাদের সবাইকে বিচারের সম্মুখীন করা উচিত। কিন্তু বিচারের আগেই মব সৃষ্টি করে তাদের হেনস্তা করার মাধ্যমে অপরাধীর বিমানবিকীকরণের যে উদাহরণ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা মোটেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত নয়। উপরন্তু বিচার বরবাদের নমুনা তৈরি করছে। সুষ্ঠু তদন্ত না হলে এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় না আনা হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটার আরও সুযোগ তৈরি হবে। যে যেভাবে পারে এ সুযোগের অসদ্ব্যবহার করবে। গোটা দেশ চলে যাবে মবের মুলুকে।
ইনিয়ে বিনিয়ে নয়, মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে দৃশ্যমান। পুলিশের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। অপরাধীরা যখন বুঝে ফেলে যে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে, তখন সমাজে এক ধরনের ভয় ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। যদি ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা সামাজিক শত্রুতার ভিত্তিতে কেউ সহজেই কাউকে মব দিয়ে হয়রানি করতে পারে, তাহলে তা সমাজে দীর্ঘস্থায়ী আতঙ্কের জন্ম দেবে। পুলিশের কার্যক্রমে পেশাদারত্বের ঘাটতি রয়েছে এবং মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। পুলিশ ‘যাত্রাপালার বিবেক’ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকলে বাস্তবতা পরিবর্তন হবে না। কারও কারও মাঝে আগের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে গুলিয়ে সাম্প্রতিক মবের কিছু ঘটনার জাস্টিফিকেশন দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। গেল আমলে মবের আগের নানা ঘটনার নিন্দা-সমালোচনায় ঘাটতি ছিল। উপেক্ষাও ছিল। তা ছিল চরম অন্যায়। তারা বলতে চান, আওয়ামী লীগ এ দেশে মব চালু করেছে। তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের কথা বলে গণ-আদালত বসিয়ে প্রথম বড় ধরনের মবোক্রেসির ডেমনস্ট্রেশন করে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তারা গণকারফিউ জারি, জনতার মঞ্চ স্থাপন, সচিবালয়ে হামলা, অফিসগামীদের উলঙ্গ করার মাধ্যমে আন্দোলন নাম দিয়ে যে নৈরাজ্য চালিয়েছিল তা ছিল শতভাগ মবোক্রেসি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
সেই তালিকা বিবেচনায় গণজাগরণ মঞ্চও ছিল মবোক্রেসি। যুদ্ধাপরাধীদের সাজা হিসেবে ফাঁসি নির্ধারণ করে দিয়ে সেই রায় আদায়ের জন্য তারা শাহবাগের রাস্তায় টানা কয়েক মাস ধরে গণজাগরণ মঞ্চ নামে যা চালিয়েছে সেটিও মবোক্রেসির চরম নজির। যুদ্ধাপরাধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের লাশের গাড়িতে আক্রমণ, জুতা ও ডিম নিক্ষেপ, জানাজা ও দাফনে বিপত্তি সৃষ্টি এবং কবরে হামলার ঘটনাও তাই। রায় পছন্দ না হওয়ায় আদালত প্রাঙ্গণে বস্তি বসানো ও বিচারকদের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিলও একই মানের। দ্বিমত বা ভিন্নমতে না গিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায়, অবিরাম অন্যায় করতে করতে ওই মহলের আর ন্যায়-অন্যায়ের বোধও ছিল না। সেই পরিণতিতে তারা এখন ভুগছে। চব্বিশের বিপ্লব একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রতিশোধের সুযোগ দিয়েছে। আবার সংশোধনের সুযোগও দিয়েছে। বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর মানুষের প্রতিশোধপ্রবণতাও থাকে। অপরাধী ও বিভিন্ন প্রতীকী স্থাপনার ওপর যে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, দেশে দেশে তার নজির আছে। কিন্তু দেশে ও সমাজে বেশির ভাগ মানুষ এখন যে মবোক্রেসির শিকার, এটির মাঝে হুজুগে মেতে অ্যাকশনে শামিল হওয়ার প্রবণতা বেশি। এগুলো রুখতে হবে। আইনের শাসন ও সুবিচার ফেরাতেই হবে। বল প্রয়োগে সাধিত পরিবর্তনের পর দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অবশ্যই কঠিন কাজ। শক্ত হাতে এর রাশ টানতে হয়। মবের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কয়েকটি অ্যাকশনে সেই আশাবাদের নমুনা মিলেছে।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!