অপশক্তির ন্যায়নীতিহীনতায় যুদ্ধ এবং শান্তি

প্রমিত হোসেন
২৫ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অপশক্তির ন্যায়নীতিহীনতায় যুদ্ধ এবং শান্তি


নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ^াস,

শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-

বিদায় নেবার আগে তাই

ডাক দিয়ে যাই

দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে

প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।।

-প্রান্তিক/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


মানবজাতির ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। এ কথা লিখে গেছেন জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স। অনেক গবেষণা করে, অনেক ইতিহাস ঘেঁটে তারপর তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। এটা তার মনগড়া কথা বলে উড়িয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। তা ছাড়া শ্রেণিসংগ্রামের মানে তো কেবল বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির সংগ্রাম বোঝায় না। মানবজাতির একটা সামগ্রিক বিষয় এই শ্রেণিসংগ্রাম। এখন আপনি যদি ইতিহাসের পাঠ নেন, আপনার তাতে মনে হবে মানুষের ইতিহাস যুদ্ধের ইতিহাস। পৃথিবীজুড়ে বহু প্রাচীনকাল থেকে দেশে-দেশে মানুষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে চলেছে। একের পর এক, অবিরাম। যুদ্ধমুক্ত একটা দিন খুঁজে পাওয়া ভার এই পৃথিবীতে। দেখা যায়, একই দেশ বারবার যুদ্ধে জড়াচ্ছে। যেমন, রাশিয়া। কতবার যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে সে এক ইতিহাস। যুদ্ধ হয়েছে বা এখনও হচ্ছে জাতিতে-জাতিতে। এমনকি ধর্মে-ধর্মেও। মানুষ যুদ্ধ করেই চলেছে। সেই প্রাচীন পৃথিবীতে; প্রগৈতিহাসিক যুগে এবং আজকের দিনেও। কখনোই ক্ষান্ত দিয়ে বলেনি, যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়। এসো, সবাই মিলে এবার শান্তিতে জীবন কাটাই।

যুদ্ধ সর্বদাই বীভৎস। আগেকার দিনে হোক আর আজকের দিনে হোক। তবে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ভাবনের পর আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে; সর্বনাশের চূড়ান্ত হয়ে উঠেছে পারমাণবিক বোমার এই যুগে। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জাপানে দুটি পারমাণবিক বোমা হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট। এতে তাৎক্ষণিক নিহত হয় ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ ৪৬ হাজার মানুষ। অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক। সেই পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ভয়ংকর প্রভাব আজও চলছে। এর পরও সতর্ক হয়নি মানুষ। শান্তির পথে আসেনি। বরং পাল্লা দিয়ে পরমাণু অস্ত্র বানিয়ে গেছে। এই নরকের পথ প্রথম দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; তারপর যমদূতের দেখানো পথে একে একে হেঁটেছে রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, ইসরায়েল। হাজার হাজার পরমাণু বোমা বানিয়ে মজুদ করে রেখেছে, যেগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি বোমাই যথেষ্ট পৃথিবী গ্রহটিকে তেজস্ক্রিয়তার আগুনে পুড়িয়ে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। শুনতে কিছুই না, কিন্তু পরমাণু বোমা হামলায় পুড়ে যাওয়া পৃথিবীর ছবিটা কল্পনা করে দেখুন, যেখানে জীবন্ত বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

যেসব অপশক্তির হাতে পরমাণু বোমা আছে- যেমন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল, ফ্রান্স- তারা বাকি বিশে^র মানুষকে ভয় দেখায়। হুমকি দেয়। তারা চায়, বাকি বিশে^র মানুষ যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। দাস হয়ে, হাঁটু ভেঙে নত হয়ে থাকে। অনেকে ভয় পায়। হুমকিতে আত্মসমর্পণ করে। হুমকিদাতাদের হুকুমের চাকরে পরিণত হয়। কিন্তু যারা স্বাধীনচেতা জাতি, তারা এই দাসত্ব মানতে চায় না। তখনই শুরু হয় সেই জাতির বিরুদ্ধে পরমাণু বোমাধারীদের আগ্রাসন। অনেক উদাহরণ আছে লাতিন আমেরিকায়, আফ্রিকায়, এশিয়ায়। এমনকি মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোতেও। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ইরান। ইরানে আক্রমণ করেছে পরমাণু বোমাধারী ইসরায়েল। সে চায়, ইরানকে হীনবল করতে। সে চায়, ইরান যেন পরমাণু শক্তিধর হতে না পারে। সে চায়, ইরানের সরকার উচ্ছেদ করে তার দাসদের ক্ষমতায় বসিয়ে ইরান গ্রাস করতে। সুতরাং ইসরায়েল আক্রমণ করেছে ইরানে। এখন বর্বর ইসরায়েলের সঙ্গে এই হিংস্র, জঘন্য, নির্লজ্জ আগ্রাসনে ইরানে হামলে পড়েছে পরমাণু বোমাধারী যুক্তরাষ্ট্রও। এর মধ্যে গতকাল সেখানে হয়ে গেছে যুদ্ধবিরতি ও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের একটি প্রহসন।

পারমাণবিক অস্ত্রধারীদের হাতে পৃথিবী কখনোই নিরাপদ নয়। সমস্ত প্রাণিজগৎসহ গোটা পৃথিবীকে কল্পনাতীত ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে তারা। মানব ও প্রকৃতিবিধ্বংসী অস্ত্র মজুদ রাখার পক্ষে তারা নানা রকম রাজনৈতিক যুক্তি দেখায়। এতে নাকি পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রয়েছে। এটা সম্পূর্ণ বাজে কথা। ধ্বংসাত্মক শক্তি আর ক্ষমতার প্রশ্ন ওঠে কেন? শান্তি বজায় রেখে ন্যায়-নীতি মেনে চললে ক্ষমতার প্রশ্ন অবান্তর। আসলে তারা শান্তিবাদী নয়; কোট-টাই পরিহিত ভদ্রবেশী দানব ও বর্বর। তাদের চরিত্র আর অস্ত্রধারী ছিনতাইকারীর চরিত্র একই। এই দানব আর বর্বরদের কবলে পড়ে গেছে পৃথিবীবাসী।

সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস বা আইক্যান। পৃথিবীকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার পক্ষে কাজ করে চলেছে এই সংগঠন। তারা জানিয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্রভা-ার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিবছর ব্যয় করা হয় হাজার হাজার কোটি ডলার। পৃথিবীবাসীর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, প্রাকৃতিক ও অন্যান্য বিপর্যয়ে ত্রাণ সহায়তার টাকা কাটছাঁট করে সেই টাকার সঙ্গে আরও টাকা যোগ করে তা খরচ করা হয় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কর্মসূচিতে। আইক্যান বলছে, গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে পরমাণু বোমাধারী নয়টি দেশ তাদের হাতে থাকা পরমাণু বোমাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকায়নের জন্য খরচ করেছে ১০,০০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এক বছরে দশ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। আইক্যান বলছে, এটা আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের চেয়ে প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। ‘হিডেন কস্ট্স : নিউক্লিয়ার উইপনস স্পেন্ডিং ইন ২০২৪’ শিরোনামে প্রকাশিত আইক্যানের নতুন একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য এসেছে। শুধু একবার ভেবে দেখুন, এখানে কেবল রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকায়নের খরচ উল্লেখ করা হয়েছে, তৈরির খরচ ধরা হয়নি। তৈরির খরচ আলাদা। একসঙ্গে যোগ করলে কত হতে পারে, কল্পনা করুন। ওই পরিমাণ টাকা মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, ত্রাণ, পরিবেশ সুরক্ষা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাতে খরচ করলে কী হতে পারত, সেটাও কল্পনা করুন। পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ আজও ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের মধ্যে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

এমন অবস্থার মধ্যে, কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ^াস।’ তাদের বিষনিঃশ^াসে জর্জরিত পৃথিবী। এমন এক পরিস্থিতি তারা তৈরি করেছে যে আপনি চান আর নাই চান, ওই পরিস্থিতি আপনাকে যুদ্ধে নামিয়ে দেবেই। কেন? কারণ আপনি সম্পদশালী, কিন্তু দুর্বল। অপশক্তি আপনাকে দুর্বল পেয়ে আক্রমণ করছে, করে আপনাকেই বলছে শান্তির পথে আসতে, বলছে আপনি অশান্তি সৃষ্টিকারী, আপনি মানবজাতির জন্য বিপজ্জনক। এ এক মহাভ-ামি। অপশক্তির মুখে ‘শান্তির ললিত বাণী’ মস্ত পরিহাস বৈকি।

এখন ইরানের পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। সে পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছে। আক্রমণকারী অপশক্তি তাকে যুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছে, সে চাক বা না চাক। আর যুক্তরাষ্ট্রের মতো অপশক্তিগুলো ওই যে হাজার হাজার ডলার খরচ করছে পরমাণু বোমা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, সে কি খামোখাই? এটা মনে করার আদৌ কারণ নেই। পরমাণু বোমা তারা বানিয়েছে ব্যবহার করার জন্য, কেবল ভয় দেখানোই তাদের উদ্দেশ্য নয়। আজ হোক কাল হোক তারা পরমাণু বোমা ব্যবহার করবেই। তাহলে এখন কী করবে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ? কী করা উচিত? উত্তরটা সেই কবে দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- দানবের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে। শান্তির ললিত বাণীতে কাজ হবে না। তার মানে কি যুদ্ধই সমাধান? তা অবশ্যই না। যুদ্ধবিরোধী জনতাকে সংগ্রাম করতে হবে নিজ নিজ দেশের যুদ্ধবাজ সরকারগুলোর বিরুদ্ধে। দানব অপশক্তির বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে পৃথিবীকে। এ মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প নেই।


প্রমিত হোসেন : সাহিত্য অনুবাদক। গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। আমাদের সময়-এর সহযোগী সম্পাদক